রবিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১২

দুঃখিত হিনা রাব্বানি, আমি অতীত ভুলতে অক্ষম


হিনা রাব্বানি এসেছিলেন। হিনা রাব্বানি, মানে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন, চলেও গেছেন।সকাল দশটায় এসেছেন, চলে গেছেন বিকেল চারটায়। আসা আর যাওয়ার মাঝখানে এই ছয় ঘন্টায় তিনি করেছেন অনেক কিছুই - ডি-৮ সম্মেলনের দাওয়াত পত্র দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে, সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে,দেখা করেছেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথেও।তার সাথে সাথে করে গেছেন একটি বড় সড় তামাশা, বাংলাদেশের মানুষকে অতীত ভুলে সামনের দিকে তাকাতে বলে গেছেন হিনা রাব্বানি। অতীত মানে - ঊনিশশো একাত্তর।

হিনা রাব্বানি রবীন্দ্রনাথ পড়েননি, পড়ার কথাও নয়। তার দেশ পাকিস্তান, এই দেশটি কোনদিন সৃষ্টি ও সুষমার জন্য আদর্শ নয়, শিল্প আর সৌন্দর্যের বুক ফাঁড়া লাশ পড়ে থাকে পাকিস্তানের অলিতে গলিতে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় - পাকিস্তান সেই দেশ,যেখানে হিন্দুয়ানির অভিযোগে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যাই হোক, বাংলা ভাষাকে গ্রাহ্য না করে তার দেশ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানাতে চেয়েছিল। কাজেই সেই বাংলা ভাষার সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের কবিতা হিনা রাব্বানির পড়ার সম্ভাবনা নেই তেমন।কিন্তু যদি ভুলক্রমেও একবার পড়তেন, তাহলে হয়তো এই তামাশাটা করার আগে একবার ভেবে নিতেন।রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,


অদৃষ্টরে শুধালেম, চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলাম থামি
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।


হিনা রাব্বানি এক কথায় বলে দিয়েছেন অতীত ভুলে যেতে হবে। এখন একটু হিসেব নিকেশ করে দেখা যাক, আসলে ঠিক কী কী জিনিস ভুলতে হবে।



এরশাদ আলী মোড়লকে ভুলে যেতে হবে ২০ মে, ১৯৭১ তারিখটি। খুলনার চুকনগরে এদিন ইতিহাসের সর্ববৃহৎ একক গণহত্যা সংঘটিত হয়।

এর পর মিলিটারিরা রাস্তার অপর সাইডে চলে গেল এবং বটিয়াঘাটা,দাকোপ,ছিয়ানব্বই গ্রাম ইত্যাদি এলাকা থেকে আগত হাজার হাজার শরণার্থীর উপর নির্বিচারে গুলি করতে লাগলো।মিলিটারিরা প্রথমে মালথিয়া গ্রামে এসে আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে তাদের হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে।আমরা দেখতে পেলাম মেশিন গানের ব্রাশফায়ারে হাজার হাজার মানুষ পাখির মতো পড়ে যেতে লাগলেন।বৃদ্ধ মহিলা পুরুষসহ আনুমানিক ২ থেকে ৩ হাজার মানুষ সেখানে তারা হত্যা করে।

... এরপর মিলিটারিরা ওখানকার একটি রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিকে যায় এবং সেখান থেকে চুকনগর বাজারে যেয়ে গুলি করে।বাজারে তাদের গুলিতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হন।চুকনগর সরদার বাড়ি ও অন্যান্য এলাকার প্রায় চার হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করে পাকি আর্মিরা।সকাল সাড়ে ন'টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত তারা অবিরাম গুলি চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে।সাতক্ষীরা থেকে প্রথমে এক গাড়ি পাকি আর্মি আসে,পরে আরো দু'গাড়ি আর্মি এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।এরপর হত্যাযজ্ঞ শেষ হলে তারা গাড়িসহ সাড়ে তিনটায় সাতক্ষীরার দিকে চলে যায়।

... ২০-২৫ টা করে লাশ প্রতিদিন ঘ্যাংরাইল নদীতে আমরা টেনে ফেলেছি।চার পাঁচদিন যাবত আমরা এই কাজ করি।আর চুকনগরে যে লাশ পড়েছিল তা সব ভদ্রা নদীতে ফেলা হয়।


খুব দেখতে ইচ্ছা করে, অতীত ভুলে যাবার এই বচনামৃতখানি এরশাদ আলীর সামনে বলতে হলে কী করতেন হিনা রাব্বানি?

আমাদের ভুলে যেতে হবে কপিলমুনির সেই মুক্তিযোদ্ধাটির কথা যার হাতে পায়ে পেরেক বিধিঁয়ে সেঁটে রাখা হয়েছিল দেয়ালের সাথে। আমাদের ভুলে যেতে হবে সেই দেড়শো মহিলার কথা যাদের সেজদা দেবার ভঙ্গিতে বসতে বলে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হয়েছিল। ভুলে যেতে হবে কিশোরগঞ্জের বরইতলার সেই তিনশো ছেষট্টি জনকে যাদের মাথার খুলি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তিরিশ কেজি ওজনের শাবলের আঘাতে। ভুলে যেতে হবে সেই কিশোরটিকে যার পেট উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল বোমা বেঁধে। এতই সহজ !



বাংলাদেশের প্রতিটি ইঞ্চি তখন এক একটি মাইলাই, প্রতি বর্গমিটারে একজন মানুষের লাশ, প্রতিটি ঘরে একজন ধর্ষিতা। মাঠ, নদী, রাস্তা মৃতের পাহাড় - শিশুর লাশ,নরের লাশ, নারীর লাশ। মৃতের মাংসে এতটা পুষ্ট হয়েছিল একাত্তরের শকুনেরা, আকাশে উড়তে তাদের কষ্ট হতো। এসব দিনের কথা ভুলে যেতে হবে বাংলাদেশকে?



ভালুকার কিরণবালাকে ভুলে যেতে হবে তার নিজের অপমানের কথা, ভুলে যেতে হবে নিজের চোখে দেখা সেই মৃত্যুদৃশ্যের কথা !

আমার পাশেই একটা মাইয়া ছিল।দেখতে যেমন সুন্দর,বয়সটাও ছিল ঠিক।আর তারেই সবাই পছন্দ করত বেশি।তাই তার কষ্টও হইত বেশি বেশি।একদিন দুই তিনজন একলগে আহে।এরপর সবাই তারে চায়।এই নিয়া লাগে তারা তারা।পরে সবাই এক সঙ্গে ঝাঁপায় পড়ে ঐ মাইয়াডার উপর।কে কি যে করবে,তারা নিজেরাই দিশা পায়না।পরে একজন একজন কইরা কষ্ট দেয়া শুরু করে।তখন সে আর সইতে না পাইরা একজনরে লাথি মাইরা ফেলাইয়া দেয়।তারপর তো তারে বাঁচায় কেডা।হেইডারে ইচ্ছামত কষ্ট দিয়ে মাইরা ঘর থাইকা বের হয়ে যায়।আমরা তো ভাবছি,যাক বাঁচা গেল।কিন্তু না,একটু পরে হে আবার আহে,আইসাই বুটজুতা দিয়ে ইচ্ছামতো লাইত্থাইছে।তারপরে গরম বইদা ( ডিম ) সিদ্ধ করে তার অঙ্গে ঢুকায় দেয়।তখন তার কান্না,চিল্লাচিল্লি দেখে কেডা।মনে হইছিল যে,তার কান্নায় দেয়াল পর্যন্ত ফাইটা যাইতেছে।তারপরেও তার একটু মায়া দয়া হলো না।এক এক করে তিনটা বইদা ঢুকাল ভিতরে।কতক্ষণ চিল্লাচিল্লি কইরা এক সময় বন্ধ হয়ে যায়।

... তার পরের দিন আবার হেইডা আহে।আর কত চুপ থাকবে।চিল্লাচিল্লি করলে বেশি শাস্তি দিব।সেই মেয়ের কাছে গিয়ে দেখে তার অবস্থা খুব খারাপ।তখন বন্দুকের মাথা দিয়ে তার ভেতরে গুতাগুতি করছে।আরেকজন তার পেটের উপর খাড়াইয়া বইছে।আর গড় গড়াইয়া রক্ত বাইর হইতেছে।যেন মনে হয়,গরু জবাই দিছে।সে শুধু পড়েই রইল।প্রথমে একটু নড়ছিল পরে আর নড়ল না।তারপরেও তার মরণ হইল না।ভগবান তারে দেখল না।এমন কত রকম নির্যাতন করে প্রতিদিন।এই অবস্থায় বাইচা ছিল সাত-আট দিন।পরের দুই দিন চেতনা ছিল না।এক সময় অবশেষে মরল।




ঢাকা পৌরসভার সুইপার সাহেব আলীকে ভুলে যেতে হবে ২৯ মার্চ, ১৯৭১ তারিখটি, যেদিন তিনি আরমানিটোলার এক বাড়িতে দশ এগারো বছরের একটি মেয়ের লাশ পান। মেয়েটির সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত ছিল,জমাট বাঁধা ছোপ ছোপ রক্ত সারা গায়ে,এবং তার দেহের বিভিন্ন স্থানের মাংস তুলে ফেলা হয়েছিল।ধর্ষণ শেষে মেয়েটির দুই পা দু’দিক থেকে টেনে ধরে নাভি পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল।তাকে ভুলে যেতে হবে ৩০ মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের চারতলার ছাদের উপরে আনুমানিক ১৮ বছরের একটি মেয়ের লাশ পান সাহেব আলী,যথারীতি উলঙ্গ।পাশে দাঁড়ানো একজন পাক সেনার কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন মেয়েটিকে হত্যা করতে ধর্ষণ ছাড়া অন্য কিছু করার দরকার পড়েনি,পর্যায়ক্রমিক ধর্ষণের ফলেই তার মৃত্যু ঘটে।মেয়েটির চোখ ফোলা ছিল,যৌনাঙ্গ এবং তার পার্শ্ববর্তী অংশ ফুলে পেটের অনেক উপরে চলে এসেছে,যোনিপথ রক্তাক্ত,দুই গালে এবং বুকে ছিল কামড়ের দাগ।




পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া সেই মায়ের ভুলে যেতে হবে জলে ডুবে মরে যাওয়া সন্তানটির কথা।

But the huts had been built below flood level and the water had risen in the huts to a depth of about two feet. A crowd stood around one in particular. With the endless rain the roof had given way. Most of the people had got out. But a baby, knocked on to the ground had either drowned or suffocated and its little body was held by a weeping mother. Guilty of nothing, life was suddenly over. I could not look at the parents who had come so far only to find this extra tragedy at the end of a road of tears.






হিনা রাব্বানি আমাদের কী ভুলে যেতে বলেন? ১৬ ডিসেম্বর? ২৫ মার্চ? ভুলে যেতে বলেন চুকনগর-রায়েরবাজার-গোলাহাটা? ভুলে যেতে বলেন পিতার লাশ, মায়ের থ্যাঁতলানো শরীর? বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে শকুন আর শেয়ালের দল হত্যার উৎসব চালিয়েছে সেই স্মৃতি ভুলে যেতে বলেন হিনা রাব্বানি?

দুঃখিত মিসেস রাব্বানি। আমি আমার জন্মের ইতিহাস ভুলতে অপারগ।আমি ভুলতে পারবো না কীভাবে আপনার রাষ্ট্র আমার দেশের মানুষকে হত্যা করেছে - গুলি করে,জীবন্ত কবর দিয়ে,জবাই করে। আমি ভুলতে পারবো না কীভাবে আপনার সেনাবাহিনী আমার বোনকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে যোনীপথে বেয়নেট ঢুকিয়ে। আমি ভুলতে পারবো না সেই মৃত্যুময় বিষাক্ত দিন ও রাত, আমি ভুলতে পারবো না জমাট রক্ত আর থকথকে মগজে ঢেকে থাকা স্বাধীনতার সিঁড়িপথ।

আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক
কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে
মগজের কোষে কোষে যারা
পুঁতেছিল আমাদেরই আপন জনেরই লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত
যারা গণহত্যা করেছে
শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু
সেই সব পশুদের।

ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে
নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকেবুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ
দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু
করি না কামনা।

আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনেবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি, আমি সেইসব দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিত নাছোড় মৃতদেহ,
অভিশাপ দিচ্ছি
প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে
দশ হাত দূরে সর্বদাই।

অভিশাপ দিচ্ছি
ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র
জোয়ারের মত।
অভিশাপ দিচ্ছি
স্নেহের কাঙ্গাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এপাড়া ওপাড়া,
নিজেরি সন্তান
প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না
চিনতে কখনো;

অভিশাপ দিচ্ছি এতোটুকু আশ্রয়ের জন্য, বিশ্রামের
কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে
দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা। প্রেতায়িত
সেই সব মুখের উপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট,
অভিশাপ দিচ্ছি
অভিশাপ দিচ্ছি,
অভিশাপ দিচ্ছি...

দুঃখিত হিনা রাব্বানি, আমি অতীত ভুলতে অক্ষম।

তথ্যসূত্র
১) বীরাঙ্গনাদের কথা - সুরমা জাহিদ
২) '৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ - ডা. এম এ হাসান
৩) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান - শাহনাজ পারভিন
৪) The Testimony of Sixty - Published by Oxfam

কবিতা
অদৃষ্টরে শুধালেম - চালক/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমাদের বুকের ভেতর যারা - অভিশাপ দিচ্ছি/শামসুর রাহমান


 প্রথম প্রকাশ :

সোমবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১২

মৃত্যুপুরীতে দশমাস : পাকিস্তানে শেখ মুজিবের বিচার ও বন্দিজীবন - প্রথম পর্ব

মুক্তিযুদ্ধের যেসব অধ্যায় নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আলোচনা অথবা গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি সম্ভবত পাকিস্তানে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার ও বন্দি জীবন।এবং ঠিক এই অধ্যায়টি নিয়েই জামাত-শিবির তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রোপাগান্ডাটি চালায় - শেখ মুজিব ক্ষমতার লোভ ও জীবনের ভয়ে দেশের জনগণকে মৃত্যুর মুখে ফেলে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

এখানেই প্রশ্ন আসে,তাহলে কি শেখ মুজিব পাকিস্তানে রাজার হালে ছিলেন সেই দশটি মাস?উত্তর হলো - না।শারীরিক ভাবে তেমন নির্যাতন করা না হলেও প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রাখা হয় তাকে,চার দেয়ালের বাইরের সমস্ত পৃথিবীর সাথে সব ধরণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে।তাকে হত্যা করার সব ধরণের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করে ইয়াহিয়া খান।পাশাপাশি শেখ মুজিবের জীবনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বেও বিচিত্র রাজনৈতিক ঘুরপ্যাঁচ দেখা যায়,অন্তর্ঘাতের প্রচেষ্টা দেখা যায় মুজিবনগর সরকারের মাঝেও।সেই দশটি মাস কেমন ছিলেন শেখ মুজিব?কেমন ছিল তাকে ঘিরে বিশ্বরাজনীতির সমীকরণ?কীভাবে হয়েছিল তার বিচার?এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই পোস্টে।


বিগবার্ড ইন কেজ : ঢাকা থেকে লায়ালপুর

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করার সাথে সাথেই নজর দেয় শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের দিকে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মিশনের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জহির আলম খান। প্রথমেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নির্মীয়মাণ সংসদ ভবনে,সেখান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে কী করা হবে সে বিষয়ে কিছু জটিলতা দেখা দেয়।এ ব্যাপারে টিক্কা খানের এডিসি মেজর এস. জি. জিলানির বক্তব্যে জানা যায়,

গ্রেফতারের পর শেখ মুজিবকে রাখা হয়েছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।তিনি ছিলেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বন্দি।আমাদের ভয় হচ্ছিল,কোনো বিদেশী রাষ্ট্র,বিশেষভাবে ভারত,তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার চেষ্টা নিতে পারে।তার অবস্থান গোপন রাখা হয়েছিল এবং এক জায়গাতেও তাকে রাখা হতো না।তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাবার ব্যবস্থা দুইবার বাতিল করা হয়েছিল এই ভয় থেকে যে,খবরটা ভারতে পাচার হয়ে গেছে এবং মধ্য-আকাশে বিমানকে ভারত ধাওয়া করতে পারে।


করাচি বিমানবন্দর থেকে তোলা এই ছবিটি পাকিস্তান সরকার প্রকাশ করে,শেখ মুজিবকে যে বাস্তবিকই গ্রেফতার করা হয়েছে সেটা প্রমাণ করতে।তবে দিন-তারিখ জানানো হয়নি।



এর পর করাচি হয়ে শেখ মুজিবকে নিয়ে যাওয়া হয় লায়ালপুর কারাগারে,যেটি বর্তমানে ফয়সালাবাদ সেন্ট্রাল জেল নামে পরিচিত।কারাগারটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ,ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শহিদ ভগৎ সিং এই কারাগারেই বন্দি ছিলেন।এখানেই একাত্তরের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাখা হয় শেখ মুজিবকে।তবে ঠিক কত তারিখে তাকে ঢাকা থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় সেটা নির্দিষ্টভাবে জানা যায়না।প্রাপ্ত তথ্য থেকে একটি আনুমানিক ধারণায় আসা যেতে পারে।২ এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকা লন্ডন থেকে প্রকাশিত দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সূত্র দিয়ে জানায় যে শেখ মুজিবকে লাহোরে এনে রাখা হয়েছে এবং তার বিচার করা হবে।




আমরা ধারণা করতে পারি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১ এপ্রিল।এখান থেকে বলা যায় ৩১ মার্চের মধ্যেই শেখ মুজিবকে লাহোরে নিয়ে আসা হয়।অন্যদিকে এস. জি. জিলানির বক্তব্যটি আমলে নিলে আরো ধারণা করা যেতে পারে,অন্তত ছাব্বিশে মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিব ঢাকাতেই ছিলেন।দুইবার পরিকল্পনা বাতিলের প্রসঙ্গটি থেকে বলা যায়,এই থাকা সাতাশ মার্চ পর্যন্তও প্রলম্বিত হতে পারে।অর্থাৎ সাতাশ থেকে একত্রিশ মার্চ - এই পাঁচদিনের মধ্যে কোন একদিন শেখ মুজিবকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতার তথ্য সংগ্রহের সময়কাল যদি একদিন ধরে নেই,তার সাথে পূর্বে ধরে নেয়া সাতাশ মার্চ সংক্রান্ত সম্ভাবনাটি হিসেবে আনলে এই সময়সীমা দাঁড়ায় আটাশ থেকে তিরিশ মার্চ।এই তিনদিনের মধ্যেই তাকে পাকিস্তানে নিয়া যাবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।শামসুল হুদা চৌধুরি মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর বইতে ২৯ মার্চের কথা বলেছেন।তারিখটি নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে।আপাতত এর চেয়ে ভালো অনুমান আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়।আমরা বড়জোর প্রত্যাশা করতে পারি,কোন একদিন ইতিহাস তার এই গোপনীয়তাটুকু আমাদের সামনে উন্মুক্ত করবে।

চার দেয়ালের পৃথিবী
লায়ালপুর কারাগারের সেলে কার্যত অজ্ঞাতবাস শুরু করলেন শেখ মুজিব।গোটা পৃথিবীর কাছ থেকেই বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি,বাইরের দুনিয়াও জানতো না তার খবর।চার দেয়ালের পৃথিবীতে ছিল একটা বিছানা আর ধরাছোঁয়ার বাইরে একটি জানালা।মাঝে মাঝে এক টুকরো আকাশ দেখা আর কিছু বাতাসের আসা যাওয়া ছাড়া জানালাটির অন্য কোন ব্যবহার ছিল না।তিনি এমনকী এটিও জানতেন না যে তাকে কোন এলাকায়,কোন কারাগারে রাখা হয়েছে।এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব নিজেই বলেছেন,

বাইরের দুনিয়ার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না।কোন পত্রিকা,বই অথবাপরিবারের কাছ থেকে পত্র,কিছুই ছিল না - ২৭ ডিসেম্বর অবধি।সবসময়ে ছিল অন্ধকার ও চারপাশ থেকে যেন চেপে বসে থাকতো সেল।যেসব অফিসার আমাকে পাহারা দিতো ও প্রহসনের মামলায় যেসব লোক জড়িত ছিল তাদের বাইরে গোটা নয় মাসে আর কাউকে দেখিনি।


সানডে টাইমস পত্রিকায় ৮ অগাস্ট,১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত ইয়াহিয়া খানের একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করা হয় সেলে শেখ মুজিবের জন্য পাখা ও গরম পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।একজন ডাক্তার তাকে প্রতিদিনই দেখতে আসেন।ইয়াহিয়ার বক্তব্য অনুসারে শেখ মুজিব কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন।তবে ইয়াহিয়ার বক্তব্য অতিকথন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।কারণ,পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যমে তখন মুজিব সম্পর্কে বিভিন্ন খবর প্রচার করা হচ্ছিল যাতে বহির্বিশ্বে এই ধারণা তৈরি হয় যে মুজিব ভালো আছেন।পাকিস্তানের উর্দু পত্রিকা ইমরোজ তাদের খবরে জানায়,শেখ মুজিবকে দুই জন সহচর দেয়া হয়েছে এবং প্রতিদিন তিনি সব কটি জাতীয় দৈনিক পাচ্ছেন।তাকে নিয়মিত ভাত-মাছ-মাংস-ফল ইত্যাদি বাংলা খাবার খেতে দেয়া হয়।ইয়াহিয়ার বক্তব্যও প্রায় একই ধরণের।সহচর এবং পত্রিকার কথাটি মিথ্যা।ইমরোজ পাকিস্তান ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্ট পরিচালিত পত্রিকা।এখানে সহচর এবং পত্রিকার খবরটি মিথ্যা।মুক্তি পাবার পর লন্ডনে সংবাদ সম্মেলনের জন্য ইস্যুকৃত বিবৃতিতে শেখ মুজিব বলেন,

I knew nothing of the victory of the liberation forces until Bhutto told me.I came to know about India-Pakistan war after black out was observed in the jail area for fear of dark attack.They kept me in the worst possible solitary cell in the jail and did not provide me any radio or letters.Even I was not allowed to know any news of the world.


মিথ্যা খবর প্রচার করা হয়েছিল বেগম মুজিব সম্পর্কেও।বলা হয় বেগম মুজিব সহ শেখ মুজিবের পরিবারকে করাচি নিয়ে আসা হয়েছে।এটি প্রচার করে ইউএনআই।জুন মাসের দিকে প্রচারিত একটি খবরে বলা হয় শেখ মুজিব অনশন শুরু করেছেন,স্ত্রী ও পরিবারের দেখা পেলেই কেবল অনশন ভাংবেন।অন্য একটি খবরে বলা হয় তিনি উন্মাদ হয়ে গেছেন,সারাদিনই প্রলাপ বকছেন।কায়হান ইন্টারন্যাশনালের আমির তাহেরি এই সংবাদ নাকচ করে দিয়ে বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে জানান মুজিব সুস্থ আছেন।

কারাগারে মুজিব শান্ত ছিলেন বলে জানা যায়,অথবা ধারণা করা যেতে পারে কারা কর্তৃপক্ষ কিংবা পাকিস্তান সরকার যেন কোনোভাবেই তার উদ্বেগ সম্পর্কে ধারণা করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি সচেষ্ট ছিলেন।সেলের ভেতর পায়চারি করতেন,নিয়মিত কোরান শরীফ পড়তেন,নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথেই কথা বলতেন না।কারারক্ষীরা তাকে সালাম জানালে ছোট করে উত্তর জানাতেন কেবল।রক্ষীরা তার সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহারই করতো,তাদের কথায় এবং আচরণে সমীহ প্রকাশ পেত।তাদের উপরও নির্দেশ ছিল বন্দির দৈনিক কার্যক্রম সম্পর্কে রিপোর্ট দেয়ার।মুজিব প্রতিদিন কী কী করেছেন তা জানতে আগ্রহী ছিলেন ইয়াহিয়া খান।রক্ষীরা প্রতিদিনই মুজিবের খাওয়া,ঘুম,কথা এবং অন্যান্য আচরণ সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠাতো।

সে বছর ঈদের দিনটি কেমন কেটেছিল শেখ মুজিবের?সেটাও শোনা যাক তার ভাষাতেই।প্রসঙ্গত,সে বছর ঈদ-উল ফিতর ছিল ২০ নভেম্বর,সেদিন লায়ালপুরের কারাগারেই ছিলেন তিনি।এর ক'দিন পরেই মিয়ানওয়ালি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।

নিষ্ঠুর গণহত্যাকারীদের দয়ার উপর নির্ভরশীল বন্দির ব্জন্য ঈদ এক নিষিদ্ধ স্বপ্নের মতো।আর আমি তো সাধারণ কয়েদি ছিলাম না,একনায়ক সরকার ঘোষিত শত্রু আমি।তাই ঈদের দিনেও ওরা আমাকে সেল থেকে বের হতে দেয় নি।

বহুদিন যাবৎ আটক থেকে আমি সময়ের হিসেব হারিয়ে ফেলেছিলাম।নরক-সম সেলের বাইরে ইতিমধ্যে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়ে গেছে,এমনি অবস্থায় সেকেন্ডের ভগ্নাংশকেও মতো জীবনের কিছুটা সম্প্রসারণ অথবা মৃত্যুর সাময়িক পশ্চাদপসরণ।

মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা বন্দির অন্তিম ইচ্ছা পূরণের মতো জেলার আমাকে কিছু ফল পাঠিয়েছিলেন।ঈদের নামে এটা এক ধরণের রসিকতাও হতে পারে।কিন্তু আমার আবারও মনে পড়ে গেল দেশে আমার জনগণের কথা এবং বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো আমার হৃদয়।মনে পড়লো ২৫ মার্চ রাতের নিষ্ঠুর দৃশ্য,যখন বলপূর্বক আমাকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া হলো বাংলাদেশ থেকে এবং অন্তরে রক্তক্ষরণ শুরু হলো।আমার প্রিয় জনগণ কীভাবে তাদের ঈদ উৎসব পালন করছে?এই প্রশ্ন আমি করলাম,জানি না কাকে !

সেই দিন,আবার কখনো তাদের দেখা পাবো কি না সেটা না জেনেই,আমি মোনাজাত করে আমার জনগণের মঙ্গল ও নিরাপত্তা দয়াময় আল্লাহতালার হাতে সমর্পণ করলাম।এটাই ছিল আমার ঈদ।


এটা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়,মৃত্যুর সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন শেখ মুজিব।এবং সেটা মাথায় রেখে সম্পূর্ণ শান্তভাবে কারাজীবন পার করছিলেন।অথবা ধারণা করা যেতে ভেতরের অস্থিরতা সামরিক কর্তৃপক্ষ বা পাকিস্তান সরকারকে বুঝতে দিতে চাননি কোনোভাবেই।নিজের আত্মমর্যাদা নিয়েও শতভাগ সচেতন ছিলেন তিনি,একবারের জন্যও ভুলে যাননি যে তিনি একটি স্বাধীন,সার্বভৌম রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকার প্রধান।বিচার চলাকালীন সময়ে তার প্রমাণ মেলে।সব মিলিয়ে বলা যায় স্থৈর্য,ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথেই সম্ভাব্য মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন শেখ মুজিব।


সামরিক আদালতে বিচার : আরেক প্রহসন
শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের পরপরই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মোটামুটি ভাবে জানিয়ে দেয় যে তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ১৪ এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত সিডনি শনবার্গের একটি প্রতিবেদনে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।তবে ইয়াহিয়া খানের ইচ্ছা ছিল আরো একটু উঁচুতে,তিনি প্রথম থেকেই শেখ মুজিবকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ অফিসারদের মনোভাবও এর থেকে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না।এর প্রমাণ মেলে রেডিও অস্ট্রেলিয়ার বরাতে,তারা জানায় ২৬ মার্চ শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের আঠারো ঘন্টা পর ইয়াহিয়া এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানায় যে,শেখ মুজিবকে মরতেই হবে।ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তৎকালীন তথ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত রোয়েদাদ খান একটি সভার কথা জানান,যেটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইয়াহিয়া খানের হেডকোয়ার্টারে।সভায় জেনারেল গুল হাসান খান শেখ মুজিবের প্রসঙ্গটি তোলেন।ইয়াহিয়া সভায় উপস্থিত প্রত্যেকের কাছে জানতে চান - মুজিবকে হত্যা করা হবে,সেটি বিচার করে হবে নাকি না করে হবে?উপস্থিত প্রত্যেক সামরিক অফিসার ও দু'জন ছাড়া সব বেসামরিক প্রতিনিধি বিচার না করেই হত্যার পক্ষে মত দেন,রোয়েদাদ খানও তাই করেন।অফিসাররা আফসোস প্রকাশ করেন,কেন সামরিক অভিযানের প্রথম ভাগেই শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলো না !

যদিও শেষ পর্যন্ত বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল,এবং সেটি অগাস্টের মাঝামাঝিতে।প্রশ্ন আসতে পারে,সেনা কর্মকর্তারা মুজিবকে হত্যার ব্যাপারে এতটা স্থির চিত্ত থাকলে বিচারের উদ্যোগ কেন?এত দেরিতেই বা কেন? এর একটি উত্তর হতে পারে আন্তর্জাতিক চাপ।ছাব্বিশে মার্চের পর থেকেই ভারত শেখ মুজিবের ব্যাপারে নিয়মিত ভাবে উদ্বেগ জানাতে থাকে,সোভিয়েত ইউনিয়নও দ্রুত যোগ দেয় তাদের সাথে।৩১ জানুয়ারি ভারতের পার্লামেন্টে বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি রেজ্যুলেশন গৃহীত হয় । ২ এপ্রিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদ্গর্নি ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি লেখেন যাতে শেখ মুজিব সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।বিশ্ব জনমতও দ্রুত শেখ মুজিবের পক্ষে চলে যায়।আরো একটি সম্ভাবনার কথা ধারণা করা যেতে পারে,শেখ মুজিবকে শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ,এমনকী যুক্তরাষ্ট্রও।এই দু'টি বিষয় পরে আলোচনা করা হবে।

জুলাই মাসেই শেখ মুজিবের বিচারের প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় ধরণের আলোড়ন তোলে।এ সংক্রান্ত খবরের ভিত্তিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতিনিধি হিসেবে আইরিশ বারের সদস্য শন ম্যাকব্রাইডকে ইসলামাবাদ পাঠায় শেখ মুজিবের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য।এ সময়ে আইনী পরামর্শ দেয় লন্ডনভিত্তিক আইনী সহায়তা দানকারী সংস্থা বার্নার্ড শেরিডান।পাকিস্তান থেকে ফিরে শন ম্যাকব্রাইড ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি লেখেন যাতে সামরিক আদালতে বিচারের ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানানো হয়,

Every State recognises that it is bound by the Rule of Law and that, save in very exceptional circumstances, no civilian should be tried by a Military Tribunal. This is not to imply that military officers are less fair than civilian judges; but military courts are by their nature intended to be summary. The rules and procedures of civilian courts in criminal cases were devised with care to ensure that the highest degree of fairness and objectivity would be assured in the trial of persons accused of crime.


২৯ জুলাই ভারতের লোকসভার সদস্য কুমারস্বামী কামারাজ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্টের কাছে শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে একটি চিঠি লেখেন। জবাবে উ থান্ট জানান ,তার সাধ্যের মধ্যে তিনি সবকিছুই করবেন।

জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত জয় বাংলা পত্রিকায় বিচার কীভাবে হবে সে ব্যাপারে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়।বিবিসির সূত্রে পত্রিকাটি জানায় খুব শীঘ্রই সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।২২ জুলাই ইসলামাবাদস্থ মার্কিন দূতাবাস জানায় গোপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার হবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে জানা গেছে।৩ অগাস্ট পাকিস্তানের সকল টেলিভিশন স্টেশন থেকে প্রচারিত একটি সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া জানান, বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার করা হবে।শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার এই ঘোষণা পূর্ণতা পায় ৯ অগাস্ট, একটি প্রেস নোটের মধ্যমে ।সেখানে বলা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা এবং অন্যান্য অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার করা হবে,বিচারটি হবে সামরিক আদালতে এবং সম্পূর্ণ গোপনে।বিচার শুরু হবে ১১ অগাস্ট,বিচার সংক্রান্ত সব কার্যবিবরণী গোপন রাখা হবে।আসামী তার পছন্দের আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন এবং তাকে পাকিস্তানের নাগরিক হতে হবে।অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুতর,শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।অন্যান্য অভিযোগগুলো কী কী ছিল সে ব্যাপারে কিছুটা জানা যায় দেশে ফেরার পর সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া শেখ মুজিবের একটি সাক্ষাৎকারে ( লিঙ্ক - প্রথম অংশ , দ্বিতীয় অংশ )।কী কী অভিযোগ আনা হয়েছিল এই প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন,

Treason, war against the Pakistan Government, against the armed forces, wanting to make Bengal independent and what not?Twelve charges out of which for six charges the punishment is hanging.




রেডিও অস্ট্রেলিয়া এই খবরটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রচার করে।তাদের বক্তব্য ছিল - বিচারের রায় আগে থেকেই ঠিক করা আছে।রায় হতে পারে কেবল একটিই - দোষী।তারা জানায়,পাকিস্তানে কারো - বিশেষ করে সামরিক আদালতের - সাহস নেই ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে যাবার।


আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও পাকিস্তানের পিছটান


এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক।১০ অগাস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চব্বিশটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে একটি বার্তা পাঠান এই গোপন বিচারের প্রতিবাদ ও মুজিবের মুক্তির দাবি জানিয়ে,

Government and people of India as wellas our Press and Parliament are greatly perturbed by the reported statement of President Yahya Khan that he is going to start secret military trial of Mujibur Rahman without affording him any foreign legal assistance. We apprehend that this so-called trial will be used only as a cover to execute Sheikh Mujibur Rahman. This will aggravate the situation in East Bengal and will create a serious situation in India because of the strong feelings of our people and all political parties. Hence our grave anxiety. We appeal to you to exercise. your influence with President Yahya Khan to take a realistic view in the larger interest of the peace and stability of this region.


দেশ গুলো হলো - সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র, সিলন, তানজানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়া, জাম্বিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, কানাডা, ফ্রান্স, ইটালি, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, হল্যান্ড, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানি, ঘানা, যুগোশ্লাভিয়া, চিন, মিশর ও ইরাক। একই বার্তা পাঠানো হয় উ থান্টের কাছে ।পরবর্তীতে তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছেও পাঠানো হয়।

একই দিনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংও উ থান্টের কাছে লেখা চিঠিতে জানান ,মুজিবের কিছু হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।

মার্চে গণহত্যা শুরু হবার পর এতদিন পর্যন্ত জাতিসংঘ তেমন কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হলেও এবার কিছুটা নড়ে চড়ে বসে।১০ অগাস্ট উ থান্ট ইয়াহিয়ার কাছে লেখা এক চিঠিতে জানান,

The Secretary General feels that it is an extremly sensitive and delcate matter which falls within the competence of the judicial system of a member state,in this case,Pakistan.It is also a matter of extraordinary interest and concern in many quarters,from a humanitarian as well as from a political point of view.The Secretary General has received and is still receiving almost everyday expression at serious concern from representatives of governments about the situation of East Pakistan an there is a general feeling that the restoration of peace and normalcy in the region is remote unless some kind of accommodation is reached.The Secretary general shares the feelings of many representatives that any developments concerning the fate of Sheikh Mujibur Rahman will inevitably have repurcussions outside the borders of pakistan.


ইন্দিরা গান্ধী এবং শরণ সিংয়ের কাছে লেখা ফিরতি চিঠিতেও উ থান্ট জানান যে তিনি যথা সাধ্য চেষ্টা করছেন।

মুজিবের যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮ জন কংগ্রেস সদস্য ও এগারো জন সিনেটর স্বাক্ষরিত একটি টেলিগ্রাম পাঠানো হয় পাকিস্তান সরকারের কাছে।১৭ অগাস্ট ইয়াহিয়ার কাছে চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানায় ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্ট কমিশন।২০ অগাস্ট ওয়ার্ড প্রেস কাউন্সিল এই বিচারের মাধ্যমে যে সম্ভাব্য দুর্যোগের আশংকা তৈরি হয়েছে তা এড়াতে পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করে।




এই সময়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে।৯ অগাস্ট নয়াদিল্লীতে ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।চুক্তির পরপরই উপমহাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়।ভারতের রাজ্যসভায় শরণ সিং জানান সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রী আন্দ্রে গ্রমিকো এ ধরণের প্রহসনের বিচারের ঘোরতর বিরোধী।এর পরপরই বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিব ইস্যুতে মার্কিন মনোভাবেও কিছুটা পরিবর্তন আসে।সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সংঘর্ষে যেতে রাজি না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে শেখ মুজিবের ব্যাপারে দেখে শুনে পা ফেলতে বলে সতর্ক করে দেয়।



এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের একগুঁয়ে মনোভাব যদিও পাল্টায়নি,কিন্তু কিছুটা হলেও সমঝোতার মনোভাব তৈরি হয়।বস্তুত এসময় ইয়াহিয়া খান মুজিবের বেঁচে থাকার বিনিময়ে একটি জুয়া খেলার পরিকল্পনা করে।একই ধরণের চিন্তা নিয়েই নতুন করে কুটনৈতিক ছক সাজায় যুক্তরাষ্ট্র।এমন একটি অবস্থায় ১১ অগাস্ট বিচার কার্য শুরু হলেও চমকপ্রদ ভাবে সেদিনের পরই কিছুদিনের জন্য তা বন্ধ হয়ে যায়।যদিও এসময়ে মুজিবের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের কারণ দেখিয়ে বিচার বন্ধ করা হয়,তবে বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের অব্যবহিত প্রতিক্রিয়াই এর পেছনে মূল কারণ।


( আগামী পর্বে সমাপ্য )


তথ্যসূত্র :
১) পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন - আহমাদ সালিম ( মফিদুল হক অনুদিত )
২) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ( সপ্তম খণ্ড ) - হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত
৩) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ( ত্রয়োদশ খণ্ড ) - হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত
৪) Amnesty International Annual Report 1971-1972
৫) Foreign Affairs Record ( India ),Volume XVII
৬) একাত্তরে বিশ্বে বঙ্গবন্ধু - স্বদেশ রায়
৭) Foreign Relations of the United States,1969–1976,Volume XI,South Asia Crisis,1971 - Louis J. Smith & Edward C. Keefer
৮) মুক্তিযুদ্ধ,বাংলাদেশের জন্ম ও জাতিসংঘ - আশফাক হোসেন

কৃতজ্ঞতা :
অমি রহমান পিয়াল
এম এম আর জালাল

প্রথম প্রকাশ :

শনিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

যুদ্ধাপরাধ ১৯৭১ - পর্ব পাঁচ : লুন্ঠন,অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ

১.

৬৫,০০০ গ্রাম এই বাংলাদেশে।৫৪,০০০ বর্গমাইল এই বাংলাদেশের আয়তন।সাড়ে সাতকোটি লোক বাস করে এই বাংলায়।তারা গর্ব করে বলে গিয়েছিল যে,বাংলাদেশের লোক - জয় বাংলার লোক - স্বাধীন হবে ; কিন্তু এমন ধ্বংস করে দিয়ে যাব যে, এই দেশের মানুষ আর কোনদিনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না এবং দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাবে।


- শেখ মুজিবুর রহমান,জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া সংক্রান্ত ভাষণ,১২ অক্টোবর,১৯৭২।



পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের একটি খণ্ডচিত্র



বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যেন কখনোই স্বনির্ভর হয়ে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য সব ধরণের ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিল পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনী।গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পূর্বোক্ত উদ্দেশ্যটিকে সামনে রেখে প্রধানত চারটি উপায় অবলম্বন করে তারা।প্রথমত,পোকামাকড়ের মত বাঙ্গালিদের হত্যা করে,দেশছাড়া করে এই ভূখণ্ডে সক্ষম মানুষের শূন্যতা সৃষ্টি করা ; দ্বিতীয়ত,নির্বিচারে বাঙালি নারী ধর্ষণ করে,হত্যা করে একই সাথে বাঙালি সন্তান জন্মের প্রক্রিয়া রোধ করা এবং বাঙালি নারীর গর্ভে অবাঙালি সন্তান ঢুকিয়ে দেয়া ; তৃতীয়ত,বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী,সাংবাদিক সহ মেধাবী মানুষদের হত্যা করে বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা সৃষ্টি করা ; চতুর্থত,ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অবকাঠামোগত ক্ষতি সাধন,লুটপাট-অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ফসল ও সম্পদ ধ্বংস করে যুদ্ধোত্তর উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করা এবং ভবিষ্যত সমৃদ্ধির পথে একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাওয়া।যুদ্ধাপরাধ ১৯৭১ সিরিজের এই পর্বের উদ্দেশ্য চতুর্থ উপায় অর্থাৎ ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী শক্তি কর্তৃক সংঘটিত অপরাধসমূহ নিয়ে কিছু আলোচনা করা।



মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পালাবার সময় ভৈরব ব্রিজের একটি গার্ডার ধ্বংস করে দিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী



২.
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা এবং নারী নির্যাতন সংখ্যায় ও ভয়াবহতায় এতটাই ব্যাপক ছিল যে যুদ্ধাপরাধ বলতে প্রধানত হত্যা ও ধর্ষণই বোঝানো হয়ে থাকে প্রচলিত অর্থে।সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতেও হত্যা-ধর্ষণের ভয়াবহতার কাছে ম্লান হয়ে গেছে লুন্ঠন,অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধগুলো।তবুও হত্যা,ধর্ষণ,ভিটে হতে উচ্ছেদের পাশাপাশি এই অপরাধগুলোও আলোচনার দাবি রাখে।লুন্ঠন,অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সাধনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলো হলো -


## বেসামরিক ব্যক্তি ও স্থাপনার উপর আঘাতের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## লক্ষ্যবস্তুর বাইরে ব্যক্তি ও বস্তুর উপর সীমাহীন আঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস,মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## প্রতিরক্ষাহীন স্থান ও স্থাপনার উপর আঘাতের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## শত্রুসম্পত্তি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিসাধণের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ


৩.
এই ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর পূর্বোক্ত ভাষণে,

গুদামে খাবার ছিল না, ২৭৮ টি রেলব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছিল।সমস্ত রাস্তার ব্রিজ - প্রায় ২৭০টার মতো - ধ্বংস করে দিয়েছিল।জনাব স্পীকার সাহেব,আমার সঠিক মনে নাই - তবে ২০০ থেকে ৩০০টির মত হবে।প্রায় চাউলের গোডাউনই ধ্বংস করে দিয়েছিল।পোর্টগুলির মধ্যে মাইন বসিয়ে রেখেছিল,জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।গুদামে খাবার ছিল না।ব্যাঙ্কের পয়সা জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।ফ্যাক্টরি-কারখানাগুলি বন্ধ ছিল।স্কুল-কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি ধ্বংস করে দিয়েছিল।গ্রামের স্কুলগুলির ফার্নিচার জ্বালিয়ে রুটি বানিয়ে খেয়েছিল।


৭ ফেব্রুয়ারি,১৯৭২ দৈনিক আজাদ পত্রিকার একটি সংবাদ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যা নির্যাতনের পাশাপাশি লুটপাটের বিবরণ পাওয়া যায়,

গত ন'মাস ধরে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশে যে অবাধ হত্যালীলা চালিয়েছিল সে সময় রাজশাহী বিশ্ববদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকসহ ১৮ জন কর্মচারী নিহত হন।ঐ সময় জিনিসপত্রের দিক দিয়ে দখলদার বাহিনী ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২২ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকার মত ক্ষতি করেছে।

... বর্বর হানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে এবং জোহা হল ও অন্যান্য হলসহ কতিপয় বিল্ডিংয়ের গুরুতর ক্ষতি সাধন করে।তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিং হল এবং শিক্ষকদের কোয়ার্টার ও অন্যান্য কর্মচারীদের বাসা থেকে নানাবিধ জিনিস পত্র এবং গৃহস্থালী মাল পত্র লুট করে।এমনকী লাইব্রেরির পুস্তকাদি এবং ল্যাবরেটরি সমুহের যন্ত্রপাতিও বাদ যায়নি।


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই শুধু নয়,ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি পঁচিশে মার্চ রাতেই ধ্বংস করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।এছাড়া দেশে অন্যান্য স্থানেও শহীদ মিনার সহ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত স্থাপনা ধ্বংসে তৎপর ছিল তারা।



গুঁড়িয়ে দেয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদী


শহীদ মিনার ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনী পঁচিশে মার্চ রাতেই ধ্বংস করে রমনা কালিবাড়ি।এরপরে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সারাদেশে তারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ মন্দির,গীর্জা,প্যাগোডা এমনকী মসজিদ পর্যন্ত ধ্বংস করে।ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান পর্যন্ত রক্ষা পায়নি তাদের হাত থেকে।সাংস্কৃতিক স্থাপনার বাইরে অবকাঠামোগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও শিকার হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের।রাস্তাঘাট,ব্রিজ-কালভার্টগুলো একে একে ধ্বংস করতে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।



রক্ষা পেল না মসজিদও



ধ্বংসপ্রাপ্ত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ



ঝিকরগাছা অঞ্চলের একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু


পঁচিশে মার্চ রাতেই ট্যাঙ্ক থেকে গোলা ছুড়ে ধ্বংস করা হয় ঢাকা প্রেসক্লাব।এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন সাহিত্যিক ফয়েজ আহমেদ,

ট্যাঙ্কের নলটা ক্লাবের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে।আর কয়েকজন সৈন্য ট্যাঙ্কের কাছে ছুটাছুটি করছে।তখনও আমি ভেবে উঠতে পারিনি যে, প্রসক্লাবের উপরও তাদের সরাসরি আক্রমণ চলবে।কিন্তু পর মুহূর্তেই ভাবলাম সব অবিশ্বাস্য ঘটনাই তো তাদের দ্বারা আজ রাতে সম্ভব হয়েছে।

... আমি তখনো সোফার কাছে এসে পৌঁছাইনি - একটা ভয়াবহ শব্দে প্রথম শেল কক্ষের মধ্যে পড়ল।কোন কিছু চিন্তা করার পূর্বেই একটা ইসপ্লিন্টার প্রচণ্ড বেগে আমাকে উপড়ে ফেলল ফ্লোর থেকে।এই ইসপ্লিন্টারের প্রচণ্ডতা এতো বেশী ছিল যে,আমি কখন ফ্লোরে পড়েছি, তা বুঝতে পারিনি।আমার উপর দিয়ে পরপর আরো তিনটে শেল নিক্ষেপ করা হয়।তারপর সব নিস্তব্ধ।দু'টো দেয়ালের মধ্যে আমি পড়েছিলাম।তখনো বুঝতে পারিনি আমার দেহের কোন অংশ উড়ে গেছে কিনা।মাথা উঠোবার উপায় নেই।গোলার আঘাতে পশ্চিম দিকের দেয়াল উড়ে গেছে - বাইরে সবই দেখা যায়।


ছাব্বিশ তারিখ বিকেলে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ইত্তেফাক পত্রিকার অফিস ও প্রেস।এই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমদ,

বিকেল ৪টা নাগাদ দুই লরী বোঝাই সৈন্য হাটখোলা মোড়ে দৈনিক ইত্তেফাক অফিসের সামনে এসে হাজির।সংগে একটি ট্যাংক।কার্ফুর দরুন গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে সাংবাদিকসহ বেশ ক'জন ভিতরে আছেন ।এঁদের মধ্যে কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন,আবেদ খান,ইয়াহিয়া বখত,সিদ্দিকুর রহমান,আব্দুল গনি,সৈয়দ শাহজাহান,মাহবুব প্রমুখ।প্রথমেই মেশিনগানের গুলী দিয়ে কাগজের নেমপ্লেট উড়িয়ে দিল সৈন্যরা।বাইরে কি হচ্ছে দেখতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল ক্যান্টিনবয়।ট্যাংক থেকে মেশিনরুমে ঘন ঘন গোলা নিক্ষেপ করা হল।তারপর সৈন্যরা গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে ভিতরে ঢুকেই গ্যাসোলিন ছিটিয়ে রকেট ছুড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।



ভস্মীভূত ইত্তেফাক প্রেস


' পোড়ামাটি নীতি ' এই টেকনিক্যাল টার্মটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাস্তবে রূপ দিয়েছে দক্ষতার সাথে।দরিদ্রের বস্তি থেকে শুরু করে কলকারখানা,বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল পর্যন্ত কিছুই বাদ যায়নি।সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ ৭ এপ্রিল,১৯৭১ তারিখের একটি রিপোর্টে লিখেছেন এই ধ্বংসযজ্ঞের কথা।চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজন বিদেশী নাগরিকের অভিজ্ঞতা উদ্ধৃত করে তিনি লেখেন,

বিদেশীরা আরো জানিয়েছেন যে,২৬ মার্চ শুক্রবার খুব সকালে লড়াই শুরু হয়ে যায় এবং স্বাধীনতার সমর্থক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীর্ণ বস্তিগুলো সেনাবাহিনী পুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।গতকাল সকালে সেনাপ্রহরায় যখন তাদের বন্দরে নিয়ে যাওয়া হলো এসব বাঁশের ঘরবাড়ির পোড়া ছাই ধিকিধিকি জ্বলছিল।

... ওরা পরিকল্পিতভাবে গরিব মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে,কেননা ওদের মনে হয়েছিল এইসব বস্তিতে ভালোভাবে তল্লাশি চালানো সম্ভব নয়।যথেচ্ছ হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো তারা উপভোগ করছে বলেই মনে হয়।



২৬ মার্চ,১৯৭১ - ঢাকা জ্বলছে



বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ


লুট-পাট,চাঁদা আদায়,ভারতে অথবা অন্যত্র পালিয়ে যাওয়া বাঙালি পরিবারগুলোর বসতবাড়ি, জমি, ফসল, টাকাপয়সা, অলঙ্কার ও অন্যান্য সম্পদ নিয়মিতভাবেই দখল করতে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এব্যাপারে মূলত নেতৃত্ব দেয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী।কুড়িগ্রাম শান্তিকমিটির একটা সভার কাগজপত্রে দেখা যায়,এইসব সম্পত্তি দখল ও বন্টনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত অফিসিয়ালিই নেয়া হয়েছিল।এই সভায় গৃহিত দু'টি সিদ্ধান্ত এরকম,

১) যে সমস্ত হিন্দু গোলযোগ ব্যাপারে ভয়ে নিজ ঘরবাড়ি ও জমিজমা ছাড়িয়া সীমান্ত পার হইয়া ভারতে চলিয়া গিয়াছেন তাহাদের অস্থাবর সম্পত্তির তালিকা প্রস্তুতকরণ ও তাহা রক্ষণাবেক্ষণ করণ।
২) উক্ত হিন্দুদের স্থাবর সম্পত্তি ও জমিজমার তালিকা প্রস্তুত ও উক্ত তালিকা অনুযায়ী ইউনিটের ভূমিহীন ও দুস্থ ব্যক্তিগণের মধ্যে পাক সরকারের ইতিমধ্যে প্রচারিত নির্দেশানুযায়ী তহশীলদারের সহিত যোগাযোগ করিয়া উঠবন্দি হিসাবে বিলিবন্টন পূর্বক চাষাবাদের ব্যবস্থাকরণ।



কুড়িগ্রাম শান্তি কমিটির সভার গৃহিত হিন্দুদের সম্পত্তি দখল সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত


বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।এই অপরাধে ঢাকায় তার বাসভবনে হামলা চালায় সেনাবাহিনী।একাত্তরের নভেম্বরে আবু সাঈদ চৌধুরীর ঢাকার বাসভবনে হামলা চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার সহ অন্যান্য যাবতীয় মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়,বাসার আসবাবপত্র ভেঙ্গে ফেলা হয়,সমস্ত বাসভবনটি তছনছ করে দেয়া হয়।



আবু সাঈদ চৌধুরীর লুটকৃত বাসভবন


সিরাজগঞ্জের আবদুর রহমান জানিয়েছেন তার নিজের চোখে দেখা লুটপাট,অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী,

পাকি বাহিনী এ গ্রামে এসে প্রথমে মতি বিশ্বাসের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে।তাদের সাথে ছিল স্থানীয় রাজাকাররা।মতি বিশ্বাসের বাড়ি থেকে গয়নাগাটি সহ অনেক মূল্যবান দ্রব্যাদি লুট করে নিয়ে তারা চরপাড়ায় এসে ঢোকে।

... দেবা তালুকদারের বাড়ি থেকে তিনটি খাসী নিয়ে পাকিবাহিনী ও রাজাকাররা আমাদের বাড়িতে আসে।আমি তখন দর্জির কাজ করতাম।আমার বাড়িতে একটি মেশিন,সাইকেল ও কিছু চাইনিজ কাপড় ছিল;তারা সেগুলো নিয়ে যায়।তৎকালীন মূল্যে এগুলোর দাম ছিল প্রায় দু'হাজার টাকা। ... তারা যাবার সময় আমার বাড়িতে একটা লাল পতাকা টাঙ্গিয়ে উর্দুতে বলে যায়,এ বাড়িতে যেন আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।এরপর আমি জিনিসপত্র উদ্ধারের জন্য থানায় যাই।সেখানে নুরু নামে একজন রাজাকার আমাকে খুব ভালোবাসত।সে আমাকে বলে যে , 'মেশিনটা উদ্ধার করা যায় কি না ওসিকে বলে দেখব' । আমি দেখলাম,তারা লুট করা জিনিস পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাচার করে দিচ্ছে।


বাংলাদেশের বর্তমানে চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেলোয়ার হোসেন সাইদীর বিরুদ্ধে যে বিশটি অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে আটটিতে লুটপাট,অগ্নিসংযোগ ও মূল্যবান সম্পদ ধ্বংসের অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।এর মধ্যে একটি অভিযোগ (অভিযোগ নম্বর তিন ) নমুনা হিসেবে এখানে যুক্ত করা হলো,

That on the same date on 04.05.1971 you led a team of Pakistani Army to Masimpur Hindu Para and looted goods from the houses of Monindra Nath Mistri and Suresh Chandra Mondol and completely destroyed their houses by setting fire. You also directly took part in causing large scale destruction by setting fire on the road side houses of villages namely Kalibari, Masimpur,Palpara, Sikarpur, Razarhat, Kukarpara, Dumur Tola, Kalamtola, Nawabpur, Alamkuthi, Dhukigathi, Parerha and Chinrakhali and these Acts are considered as persecution against civilian population on religious grounds.


নারায়নগঞ্জের আলী আকবর ব্যাপারীর বাড়িটি লুটপাট শেষে পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী।কাঠের ব্যবসায়ী আলী আকবরের বাড়ির সামনে মুক্তিযোদ্ধারা গাছ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রাখায় ক্রুদ্ধ হয়ে এই কাজ করে পাকিস্তানিরা।দুইদিন ধরে তার বাড়িতে আগুন জ্বলে,বিশাল ৮ টি ঘর সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়।এমনকী,বাড়িতে আগুন লাগানোর কয়েকদিন পরে আবার ফিরে এসে দোকানের সব কাঠ গাড়িতে করে নিয়ে যায় তারা।দোকানও জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।তখনকার হিসেবে এই কাঠের দাম ছিল প্রায় তিরিশ হাজার টাকা।মুক্তিযুদ্ধের পর আলী আকবর ব্যাপারী সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যান।



৪.
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা ও নারী নির্যাতনে যতখানি পারদর্শিতা দেখিয়েছে,লুটপাট ও সম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে তার চেয়ে কিছু কম পারঙ্গম ছিল না।বহু মানুষ যুদ্ধ শেষে একেবারেই কপর্দকহীন হয়ে গেছেন,ভিটে-মাটি,সহায়-সম্বল সব কিছু হারিয়ে ভিক্ষা বৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই।রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও ভোগ করেছে এর প্রতিক্রিয়া।বিপুল এই ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতিপূরণ এখন পর্যন্ত পরিশোধ করেনি পাকিস্তান।১৯৭১ সালের হিসেবে বাংলাদেশের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের পরিমান চৌদ্দ হাজার কোটি পাকিস্তানি রুপী।সর্বশেষ,২০১০ সালে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ বাবদ পাকিস্তানের কাছে চার বিলিয়ন ডলার দাবি করেছে।এছাড়াও ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে আসা প্রায় দুই শ মিলিয়ন ডলার ঢাকায় স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে রক্ষিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ব্যাংকের লাহোর শাখায় সরিয়ে নেয়া হয়। এই বিপুল পরিমান অর্থ সরাসরি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে।

হত্যা-ধর্ষণ ও নির্যাতনের পাশাপাশি মাত্রা ও পরিমানে সুবিশাল এই ধ্বংসযজ্ঞের কথাও লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপরাধের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পেতে এই সব অপরাধও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।



তথ্যসূত্র :
১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ( অষ্টম খন্ড ) - হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত
২) '৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ - ডা. এম এ হাসান
৩) মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র - মুনতাসীর মামুন
৪) বাংলা নামে দেশ - অভীক সরকার সম্পাদিত
৫) স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙ্গালী - আফতাব আহমদ
৬) ডেটলাইন বাংলাদেশ নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান - সিডনি শনবার্গ ( মফিদুল হক অনুদিত )
৭) বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে শেখ মুজিবুর রহমান - শেখ হাসিনা,বেবী মওদুদ


যুদ্ধাপরাধ ১৯৭১ - পর্ব এক : পূর্বকথন
যুদ্ধাপরাধ ১৯৭১ - পর্ব দুই : হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ
যুদ্ধাপরাধ ১৯৭১ - পর্ব তিন : নারী নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ
যুদ্ধাপরাধ ১৯৭১ - পর্ব চার : নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ

প্রথম প্রকাশ :

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

একাত্তরের পঙক্তিমালা : অগ্নিগর্ভ অহংকারের রূপকথা

উৎসর্গ :
ডাক্তার আইজুদ্দিন
মাত্র একটি শব্দেই তাকে বিশেষায়িত করা সম্ভব - ' বিশেষণহীন '




ছবি : পাপুয়া নিউগিনি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রকাশিত পৃথ্বীন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত কবিতা সংকলন To Each My Blood And Other Hymns এর প্রচ্ছদ।

১.
ঊনিশশো একাত্তর - মহাপৃথিবীর উদ্ধত উষ্ণীষ
ঊনিশশো একাত্তর - অবারিত আকাশে ছুড়ে দেয়া উন্মাতাল স্লোগান
ঊনিশশো একাত্তর - বেদনা আর বারুদে লেখা অভ্রভেদী মহাকাব্য

মুক্তিযুদ্ধের দুইশো সাতষট্টি দিন এবং তার পূর্বাপর ছুঁয়ে গেছে বাঙালীর বেঁচে থাকার প্রতিটি অনুষঙ্গে।বাঙালীর চেতনায়,বাঙালীর আত্মমর্যাদায়,বাঙালীর রোমান্টিসিজমে,বাঙালীর প্রেমে আর পূজায় ঊনিশশো একাত্তর এক অনিবার্য ও সর্বব্যাপী উপাদান।ঊনিশশো একাত্তর সেই বিশল্যকরণী - যার হিরণ্ময় স্পর্শে ভেতো বাঙালীর হাতে বেজেছে স্টেনগানের সোনাটা,গ্রেনেডের র‍্যাপসডি।ঊনিশশো একাত্তর সেই জীয়নকাঠি যার ছোঁয়ায় কবি হয়ে উঠেছে সদ্য গোঁফ গজানো তরুণের আঙুল,জীবনে কোনদিন কবিতার একটি পাতাও হয়তো উলটে দেখেনি সে।ঊনিশশো একাত্তর সেই সঞ্জীবনী যা ঠোঁটে ছুঁইয়ে মধ্যবয়সী কেরানীর হেড়ে গলা দিয়েও বেরিয়েছে পৃথিবীর মধুরতম সুর।বুলেটে এবং বিশ্বাসে,অশ্রু আর অহংকারে,শব্দে আর উচ্চারণে ঊনিশশো একাত্তর নিজেই হয়ে উঠেছে এক অনলবর্ষী মহৎ কবিতা।


২.
যেমনটি বললাম,মুক্তিযুদ্ধ ভেতো বাঙালীকে করে তুলেছে যুগপৎ যোদ্ধা ও কবি - একচুল মিথ্যে নেই এতে।ক্যাম্পে বসে বসে মুক্তিযোদ্ধা নওয়াব আলী তাই লিখে ফেলেন -

বঙ্গ আমার জননী আমার
আমার জন্মভূমি
স্বর্গ হতে গরীয়সি মা
প্রাণ হতে প্রিয় তুমি


কী আনাবিল প্রকাশ ! কী অকপট মমতা ! এ কবিতায় শব্দের দুন্দুভি বাজে না,উপমার নূপুর নিক্কন শোনা যায় না।কিন্তু ঠিক ঠিক হৃদয়ের গহীন প্রদেশে গিয়ে ছুঁয়ে আসে।নওয়াব আলী আরো লেখেন -

বাংলাদেশ বাংলাদেশ
সবার ঊর্ধ্বে বাংলাদেশ
জানুক মানুষ সর্বলোকের
দেশবিদেশ
সব কথারই সর্বশেষ
মোদের সোনার বাংলাদেশ
বাংলাদেশ


এ এক অসংজ্ঞায়িত প্রেম।হয়তো দু'মিনিট পরেই মগজ ফুঁড়ে যাবে বুলেট,হয়তো ট্যাঙ্কের নিচে পিষে যাবে নশ্বর শরীর।মৃত্যু থেকে ইঞ্চি কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে এমন অহংকারী উচ্চারণ আর কে করতে পারে অকুতোভয় গেরিলা ছাড়া?

এই গেরিলারা শুধু নিজেরা যুদ্ধে এসেই তুষ্ট নন,দেশের যুবক তরুণদের প্রতি তাদের আহবান জারি থাকে যুদ্ধে আসার।মায়ের সম্মান যে ধুলোয় লুটেছে,দুরন্ত ছেলে তাকে না বাঁচালে আর কে আছে তার?মুজিবুর রহমান বিশ্বাস তাই ডাকেন তার তরুণ কমরেডদের -

জাগো জাগো নওজোয়ান
রাখো রাখো বাংলার মান
জয়বাংলারই গান গাহিয়া
স্বাধীন বাংলার তোল নিশান
স্বাধীন বাংলার কর্ণধার
বঙ্গবন্ধু মুজিবুর
বাঙালিদের ডাক দিয়াছে
একসাথে হও আগুয়ান


একই আকুতি শোনা যায় শাহাদাত হোসেনের গানে।স্বদেশের শত্রু,ঘরের শত্রু বিভীষণদের ব্যাপারে সচেতন তিনি।রাজাকাররাই যে বাঙালির পয়লা শত্রু সে ব্যাপারে নিশ্চিত শাহাদাত হোসেন,তাই এদের ক্ষমা না করে খতম করার ব্যাপারেও দ্বিধা নেই তার -

ঘরবাড়ি পুড়াইয়া দিল,মা বোনকে ধরিয়া নিল
সে প্রতিশোধ লইতে তোমরা কেন জাগোনা।
বাঙলা শ্মশান করলো কারা,
খান সেনা আর রাজাকাররা
ও ভাই ঘরের শত্রু বিভীষণকে ক্ষমা কইরো না।
খান-সেনারা বুদ্ধি কইরা,রাজাকার দল গঠন কইরা
ও খান কাঁটা দিয়া কাঁটা তুলছে
তোদের ভুল ভাঙলো না।
পাঞ্জাবের খান পাঞ্জাব যাবে
রাজাকার সব পড়ে রবে,
রাজাকারে সব করবো খতম
ক্ষমা করবো না।


গেরিলা কবির রসবোধ সামান্য নয়।মুজিবুর রহমান বিশ্বাস লঘুচালেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে দেন - সোনার বাংলা শ্মশান করার যে ঘৃণ্য চক্রান্ত তারা করেছে তা সফল হবার নয়,শোষণ আর দুঃশাসনের জিঞ্জিরে বাঁধা পরে থাকার জাতি বাঙালি নয় -

খানের বেটা লাফাও ক্যান
বাংলার আশা ছাইড়া দ্যান
মুক্তিসেনা তৈয়ার হল রাখিতে এ বাংলার মান।

২৩ বছরের ছল চাতুরি
এবার আমরা বুঝতে পারি
ও তাই অস্ত্র হাতে দাঁড়ায় এবার বাংলাদেশের জনগণ।

যত পাঠাও খানসেনা
করবো আমরা ফানাফানা
মুক্তিসেনার অস্ত্রাঘাতে শেষ হবে দুশমনের জান।

মনে করছ পিন্ডি বসে
বাংলা আমি খাবো চুষে
ওরে মুক্তিসেনার বজ্রাঘাতে ভাঙবে পিন্ডির সিংহাসন।

জয় বাংলার নিশান তুলে
চলছে বাঙাল দলে দলে
পারবে না কেউ রুখতে আর আসুক যত খান-পাঠান।।

শহীদ ভাইয়ের রক্ত ছুঁয়ে
পণ করেছে মুক্তি ভাইয়ে
এবার শহীদ নয় রে গাজী হব রাখবো এ বাংলার মান।


শেষের তিনটি বাক্য আবার পড়ুন তো,বুকে হাত রেখে বলুন তো এই সাদামাটা আঠারোটি শব্দ আপনার হৃদপিন্ডে কোন দাগ রেখে গেছে কি না?

মারণ আঘাত হানার ডাক দিয়েছেন সৈয়দ আমিন ঘৃণা আর প্রতিজ্ঞার মিশেলে -

বজ্র আঘাত হানো এবার
বজ্র আঘাত হানো
মুক্তিসেনারা শত্রুসেনার
কলজে ধরে টানো


ব্যাঙ্গের ছলে আরেকটি অসাধারণ কবিতা লিখেছেন মুজিবুর রহমান বিশ্বাস।গণহত্যার দুই মূল রূপকার ইয়াহিয়া আর ভুট্টোকে নিয়ে লেখা এটি -

টিক্কা কয় এহিয়ারে,শোন এহিয়া কই তোমারে
মুক্তি সেনার গাবুর মাইরে
কবর তৈয়ার করতে হয়
ভুট্টো মিয়া কয় টিক্কারে,শোন রে টিক্কা কই তোমারে
মরণ তোমার অতি কাছে
কাফনের কাপড় কিনতে হয়


বাঙালি জাতির ধ্রুব ঠিকানা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা।যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা জানেন বঙ্গবন্ধুই বাঙালির মুক্তির দিশারী।বৈঠা হাতে যে নৌকা চালিয়ে তীর হারা সাগর পাড়ি দেয়ার সংকল্প করেছেন তারা,সেই নৌকার কান্ডারী শেখ মুজিব।গেরিলা কবির কবিতার পঙক্তিতে তাই বঙ্গবন্ধুও হয়ে থাকেন অপরিহার্য চরিত্র।জাতির জনককে নিয়ে এম. এ. একবর হোসেন লিখে ফেলেন অবিস্মরণীয় একটি গান।এই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রচারিত হয়েছিল -

মুজিব বাইয়া যাওরে জনগণের নাও
ওরে মুজিব বাইয়া যাও রে
চয় দফারই নৌকাখানি এগারো দফা ছইয়া
বঙ্গবন্ধু হাল ধরেছে বাদাম দাও তুলিয়া রে।।
সাত কোটি সে নৌকার যাত্রী
সাড়ে চারশত নাইয়া
তোপ-কামানের ভয় কোরো না
নৌকা যাও বাইয়া রে।
পথে যত লাল কুত্তা আছে
মারবো বৈঠা দিয়া
তোপ-কামানের ভয় করি না
যাবো নৌকা বাইয়া রে।
আমরা যত যাত্রী আছি
যাব আগাইয়া রে,
দিছি রক্ত দিব আরো
বাংলামা'র লাগিয়া রে
মহান দেশের মহান নেতা
তোমাকে পাইয়া রে
অধীন আকবর যাত্রী হলো
ছয় দফার গান গাইয়া রে।।


কিংবা মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুসের -

সিলেটে হয় কমলালেবু
মোদের রোগীর মুখে নাই সাবু গো
ও তারা কাঁঠাল ভেঙ্গে কোষ খেয়ে যায়
মোদের চাষীর মুখে পড়ে ছাই
দেশের প্রেমিক মুজিবুর ভাই
মোদের দেশের প্রেমিক শেখ মুজিবুর ভাই
মোদের দেশদরদী শেখ মুজিবুর ভাই
ওরে তার মতো আর দরদী কে
মনের কোণে ভাব তাই


শিবিরে শিবিরে মুক্তিযোদ্ধারা এমন সব গান লিখেছেন,কবিতা লিখেছেন।যুদ্ধ শিবিরে যোদ্ধাদের দিন কীভাবে কাটে সেই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল একটি পুস্তিকা - মুক্তিবাহিনীর শিবিরে শিবিরে।উপরের কবিতাগুলো সেই পুস্তিকাতে সংকলিত হয়েছিল।



এসব কবিতায় ভাষার আধুনিকতা নেই,অলংকারের প্রাচুর্য নেই।ছন্দ-মাত্রার মাপকাঠিতে কবিতাগুলো হয়তো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে সমালোচকের কাঁচির নিচে।কিন্তু এ কবিতায় যা আছে তা কি হাজার সাধনাতেও মেলে?দেশের জন্য,মাটির জন্য,মানুষের জন্য এমন শর্তহীন,নির্ভেজাল,সহজ মমতা আর কোথায় পাওয়া যাবে?মুক্তিযোদ্ধারা জেনেছিলেন - যে যুদ্ধে তারা নেমেছেন সেটা জীবনের যুদ্ধ,বেঁচে থাকার যুদ্ধ।মাথা উঁচু করে বাঁচার যুদ্ধে নেমে মৃত্যু থেকে খুব বেশি দূরে তারা ছিলেন না।তবুও তাদের সহজ ও সত্য উপলব্ধি ছিল স্পষ্ট,অভ্রান্ত - স্বাধীনতা।সেই সহজ-সত্য উপলব্ধিই উঠে এসেছে এসব কবিতায়।


৩.
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক দৃঢ়তা অক্ষুণ্ণ রাখতে কিংবা সাধারণ মানুষের - যাদের নাগালে এসব পত্রিকা আসা সম্ভব ছিল - মনোবল বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে এসব পত্রিকা বড় অবদান রাখে।পাশাপাশি রনাঙ্গনের সংবাদ,আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে কে কীভাবে দেখছে সেসব খবর জানার জন্যও এই পত্রিকাগুলো কার্যকরী ছিল।এসব পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাগুলোর কথাও আলাদাভাবে বলতে হয়।কবিতায় উঠে এসেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা,গণহত্যার নৃশংসতা।উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় প্রজ্ঞার কথাও।

জওহর দাসের নিজে দেখে এলাম কবিতায় দেখতে পাই হত্যা-ধর্ষণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখার ইতিবৃত্ত -

গাড়িটা জোরেই এগিয়ে চলেছে-
সবকিছু পেরিয়ে ধ্বংস ও শবস্তুপের রাজ্য ছাড়িয়ে,
হঠাৎ এক সময় থেমে গেল,পেন্ডুলামের গতিতে এগিয়ে চলা
মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত্ত।
নিবিড় অন্ধকার রাতের সবকিছু বিদীর্ণ করে,
হাজার শব্দের সাথে ভেসে এল কয়েকটি শব্দ।
রক্তাপ্লুত কয়েকটি দেহ মৃত্যুর হাত ধরেও শাসিয়ে গেল-
যেন বলে গেল, " এত অত্যাচার অবিচার
কেউ কোনদিন সহ্য করবে না"
তখন আমাদের গাড়িটা একটু আস্তে চলছে দেখলাম,এক তরুণীর মাতৃত্বের বহিপ্রকাশটা
জঙ্গীজল্লাদের রক্তমাখা মুঠোয়-
অপরজন পাশবিক অত্যাচারে তাকে উলঙ্গ করছে।
ভয়ে বিস্ময়ে কখন জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম জানি না।
যখন জ্ঞান ফিরিল,দেখলাম -
মুক্তিসেনানীরা আমাকে ঘিরে রয়েছে,
আমাকে সেবা করছে -
আর পূর্ব্বদিকে সূর্য উঠতে চলেছে।

( বাংলার কথা,২৮ অক্টোবর,১৯৭১ )

নির্মলেন্দু গুন লিখেছিলেন কংক্রিটের কোকিল

ডাকটিকেটের মতো শহীদের
রক্তকণা
লেগে থাকা স্ট্রীটে
একটি উজ্জ্বল খাম পড়ে
আছে,বিপ্লবের
কোকিল কংক্রিটে।

( স্বদেশ,১৪ জুলাই,১৯৭১ )

একই তারিখে গোলাম সাবদার সিদ্দিক লিখেছিলেন ভিয়েতনামের মানচিত্রের মত।ছয় লাইনের ছোট্ট কবিতাটিতে তুলে ধরেছেন হত্যা-ধর্ষণের ছবি -

সূর্যের রঙের রাঙানো
তোমার মানচিত্রে
আমার বোনের উলঙ্গ
হে বাংলা
বুলেট বিদ্ধ লাশটা পড়ে আছে
ভিয়েতনামের মানচিত্রের মত


৪.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে বহির্বিশ্বেও বেশকিছু কবিতার সংকলন বেরিয়েছে।সুদূর পাপুয়া নিউগিনি থেকে পৃথ্বীন্দ্র চক্রবর্তী এবং উল্লি বেইয়ার বের করেছিলেন To Each My Blood And Other Hymns ( প্রথম ছবি দ্রষ্টব্য )।সংকলনে স্থান পায় জসীমউদ্দীন,সুভাষ মুখোপাধ্যায়,আল মাহমুদ,আসাদ চৌধুরী,রাম বসু,হাসান হাফিজুর রহমান,শামসুর রাহমান সহ মোট ১৫ জনের কবিতা।সনৎ বন্দ্যোপাধায় লিখেছিলেন Bangladesh শিরোনামের কবিতাটি -

I cannot leave you,ever if I want to.
Cannot efface your memory
Engrave in me if I want to.
When I leave you.

You follow me like the fairy girl.
Winds of gold and silver in the hands
You reach me quietly,my
Bangladesh.


যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত বাংলার কথা পত্রিকায় কবি দিনেশ দাস লিখেছিলেন এপার ওপার জুড়ে দু'পার বাংলায়

হঠাৎ ঝড়েতে যেন আজ
বিদীর্ণ হয়েছে বিশাল জাহাজ,
সে জাহাজ যেতে যেতে ভেঙ্গে পড়ে বাংলাদেশের হৃদয়েতে।
অবিরত
চোখের জলের মত ভেসে আসে কত শব মৃত্যু নিয়ে হাড়ের
ভিতরে-
এপার বাংলার ভিজে ডাঙার উপরে।
ভেসে আসে স্রোতে একটানা
আম জাম কাঁঠাল গাছের শব,মাদুর,
বিছানা,
ধুতি,শাড়ি,লুঙ্গি,পায়জামা,কাঁথা;
মরা এলোচুল ভরা মাথা
ভেসে চলে পুব হতে পশ্চিম বন্দরে-
যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সৈনিকের সাজ
পরে সেকালের যম অথবা সে মৃত্যুই স্বয়ং।
শীষ কে কালাপাহাড় ক্ষেতের সমস্ত
শীষ ছেচে ফেলে দিল অহর্নিশ
তুষ করে ছড়িয়ে দিয়েছে থরে থরে পদ্মা,মেঘনা,ভৈরবের জলের উপরে
প্রতিটি সোনার শীষ পর পর
সয়েছে অনেক মৃত্যু এক একটি ধানের ভিতর;
প্রত্যহ উৎকর্ণ হয়ে আহত,আতুর,প্রতীক্ষা করেছে শুধু চরম মৃত্যুর।
উন্মাদ সারেঙ তুমি,বোমার নখরে
আজ
ভাঙলে তোমার বাংলাদেশের জাহাজ,
প্রতিদিন
আপন হাতেই ভাঙো আপন আইন,
আগুন ধরিয়ে দিলে বসত বাড়িতে,
নিজের নাড়ীতে।
চোখ মেলে চেয়ে দ্যাখো আষাঢ়ের
জলে
অন্ধকার প্রাণের নতুন পাতা জাগে,কথা বলে;
ফুলে ওঠে শত শত কলি গানের কলির মত
সে গানে কখনো গান,কখনো
শ্লোগান কখনো তা মেশীনগানের গর্জন-
জেগে ওঠে প্রাচীন নিবিড় বন
বনের বাঁকানো লতা সাপ হয়ে উচু ফনা
তোলে।
উপরেতে লোহার আকাশ ফোলে
উদ্যত বস্ত্রের মত বিচারের তলোয়ার শুধু ঝলসায় -
এপার ওপার জুড়ে দু'পার বাংলায়।



৫.
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু বুলেট আর রক্তের নয়,এটি আসলে একটি জাতির আত্মপরিচয় সন্ধানের ইতিহাস।ঊনিশশো একাত্তর বাঙালিকে চিনিয়েছে তার সত্যিকারের পরিচয়,চিনিয়েছে তার অন্তরের বৈভবকে।একাত্তর নিজেই এক অনবদ্য কবিতা,মুক্তিযুদ্ধ নিজেই এক কিংবদন্তী,এপিক।সেই মহাকাব্যের শরীরে,সেই কিংবদন্তীর প্রতি পরতে যেমন আছে ত্যাগের গল্প তেমনি আছে সংগ্রামের গল্প।আছে প্রাণ এবং প্রতিজ্ঞার গল্প।দুর্বীনিত সাহসে বুক বেঁধেছিল বলেই বাঙালি শরীরে মাইন বেঁধে ট্যাঙ্কের নিচে ঝাঁপ দিতে পেরেছিল।অপরিমেয় প্রত্যয়ে বলীয়ান ছিল বলেই মৃতুর কোলে মাথা রেখে তারা জীবনের কবিতা লিখেছিল।

একাত্তরের পঙক্তিমালা তাই অগ্নিগর্ভ অহংকারের এক চিরন্তন রূপকথা,বাঙালির শাশ্বত স্বরূপ।


তথ্যসূত্র :
১) মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র - মুনতাসীর মামুন
২) গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (দশম খণ্ড) - হাসিনা আহমেদ

( প্রথম প্রকাশ :

মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

একাত্তরের সেইসব বিস্মৃতপ্রায় সুহৃদ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সারা পৃথিবীর মানুষকে নাড়া দিয়েছিল।ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার প্রতিবাদে নিন্দার ঝড় উঠেছে বিশ্ব মানচিত্রের প্রায় প্রতিটি কোণ থেকেই,সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অসংখ্য মানুষ।বাংলাদেশে যখন পঙ্গপালের মতো মানুষ হত্যা করা হচ্ছে ঠিক তখনই ভারতের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পথে নেমেছে শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহে।যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও সরকার যখন স্পষ্ট ভাবে দাঁড়িয়ে গেছে গণহত্যার মূল নায়কদের পক্ষে,হোয়াইট হাউসের সামনে তখন চলছে গণহত্যার প্রতিবাদে অনশন।

কোন ধরণের রাজনৈতিক সুবিধা বা উদ্দেশ্য ছাড়াই প্রতিবাদে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য মানুষ।পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কিংবা প্রয়োজনের তুলনায় এসব সাহায্য কিংবা প্রতিবাদ হয়তো খুব বড় কিছু বলে বিবেচিত হবে না,কিন্তু এক কোটি শরণার্থী কিংবা তিরিশ লক্ষ নিহত মানুষের জন্য তাদের উদ্বেগটুকু মিছে নয়।সেই ঘোর দুঃসময়ে এমন এক এক বিন্দু ভালোবাসা দিয়েই গাঁথা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত।এইভাবে,গুটিকতক স্বার্থান্বেষী কিংবা ধর্মান্ধ মানুষ ছাড়া সারা পৃথিবীর সভ্য মানুষেরা হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের একান্ত আপনজন।১৯৭১ তাই একদিকে যেমন মানবতার বর্বরতম নিগ্রহের বছর,অন্যদিকে ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে চিরন্তন মানবতার জয়গান গাওয়ার বছর।




উপরের ছবিটি প্লাইট অফ পাকিস্তানি রিফিউজি ওর্সেনস শিরোনামের একটি ব্রোশিওরের প্রচ্ছদ,প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংগঠন স্টুডেন্টস ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন।ব্রোশিওরে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে ভিটেহারা শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য চাঁদা চাওয়া হয়েছে।সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অনুরোধ করা হয়েছে গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে,পাকিস্তানের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অবস্থানের প্রতিবাদ করতে।ব্রোশিওরে পাঁচটি বিষয়ে জনমত গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল -


১) পশ্চিম পাকিস্তানে সব ধরণের বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়া।কারণ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যার জন্য তারা দায়ী।
২) আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোতে অনুদান বৃদ্ধি করা যাতে তারা দুর্দশাগ্রস্থদের সাহায্য করতে পারে
৩) ভারতকে যে ঋণ দেয়া হয়েছে তার সুদ এক বছরের জন্য স্থগিত করা যাতে ভারত শরণার্থীদের যে সহায়তা করছে তাতে চাপ কমবে।
৪) ভারতকে আরো ২৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়া
৫) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে চাপ দেয়া যাতে তিনি অযথা হত্যা বন্ধ করেন এবং ত্রাণ সামগ্রীর সরবরাহ অব্যাহত রাখার অনুমতি দেন।


কথাগুলো কি খুব আহামরি কিছু মনে হয়?এক বছরের জন্য সুদ স্থগিত করার দাবিটিকে বরং কিছুটা বালখিল্যতাই বলা যায়।তবুও,প্রতিটি শব্দই যেন বাঙালীকে জানিয়ে দিচ্ছে - তোমরা একা নও,সমস্ত পৃথিবী আছে তোমাদের পাশে।


পূর্বপুরুষের ভিটে,স্বজনের মৃতদেহ আর বারুদের গন্ধ পিছনে রেখে ছুটছে এক কোটি শরণার্থী,গন্তব্য - ভারত।সীমান্তের এপাশে নিশ্চিত মৃত্যু,ওপাশে অনিশ্চিত বেঁচে থাকা।মৃত্যু শুধু বুলেটের বেশে আসেনি তখন,এসেছে বন্যা হয়ে কিংবা কলেরার চেহারায়।সেই সময়ে জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়ালেন পশ্চিম বঙ্গের কাঁঠালি গ্রামের নলিনী মোহন বিশ্বাস।লাইফ ম্যাগাজিনের জন সার লিখেছেন -


In the village of Kanthalia tubby,globe faced man named Nalini Mohan Biswas,welcomed 125 cholera victims into the courtyard of his home when they collapsed while passing through town.Biswas himself was unprotected by a vaccination.Even so,he nursed the stricken refugees so conscientiously that only four died.


মানবতা কাকে বলে?শুভবোধের কোন কবচ-কুণ্ডল ধারণ করলে সম্পূর্ন অরক্ষিত অবস্থায়,নিজে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা জেনেও অজানা-অচেনা শতাধিক মানুষের চিকিৎসায় নিজেকে সঁপে দেয়া যায়?


রাষ্ট্রীয়ভাবে চিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে,গণহত্যায় সমর্থনও দিয়েছে।সেই চিনেও একদল তরুণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মিছিল করেছেন,চিন সফররত জুলফিকার আলী ভুট্টোকে গণহত্যার নায়ক বলে ঘোষণা করেছেন তারা।মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত আমার দেশ পত্রিকার ১১ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের খবরে জানা যায় -

চীন সফরকালে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে চীনা তরুণরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে বলে বি,বি,সি জানিয়েছেন।চীনা তরুণেরা বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে 'পূর্ব বাংলার গণহত্যার নায়ক ফিরে যাও' , 'পূর্ব বাংলার গণহত্যা বন্ধ কর' , 'মুজিবের হাতে ক্ষমতা দাও' , পাকিস্তান ধ্বংস হঊক ' প্রভৃতি শ্লোগান দেয়।


গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক পরিবহন শ্রমিক সভা।সারা পৃথিবীর ডক শ্রমিক ও নাবিকদের অনুরোধ করা হয়েছিল যেন পাকিস্তানের জন্য পাঠানো অস্ত্র ও অন্যান্য মালপত্র তারা খালাস না করেন।সাপ্তাহিক জন্মভূমির ৬ সেপ্টেম্বরের খবর -

বোম্বাই,৩রা সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক পরিবহন শ্রমিক সভা বিশ্বের সমস্ত নাবিক ও ডক শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে এক নির্দেশপত্র প্রকাশের মাধ্যমে আবেদন করেছে যে,তারা যেন সাধ্যমত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য প্রেরিত যুদ্ধের মালপত্র বহন এবং খালাস করতে অস্বীকার করেন।ভারতের জাতীয় নাবিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিঃ লিও বার্নেসের নিকট থেকে এই নির্দেশপত্র সম্পর্কে জানা গেছে।



বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি সমাধানে আসার আগে পাকিস্তানকে সব ধরণের সাহায্য বন্ধ করা হোক - এই আবেদন জানিয়েছিলেন ফ্রান্সের আশিজন বুদ্ধিজীবী,ফ্রেঞ্চ সরকারের কাছে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে তারা গঠন করেন বাংলাদেশ সহায়ক সংসদ।এর উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আলফ্রেড কাস্টলার এবং অদ্রে ভলক।এই সংগঠন থেকে প্রকাশিত একটি ঘোষণাপত্রে পাকিস্তানকে 'সামরিক ও আর্থিক সাহায্য' প্রদান বন্ধ করে দেয়ার জন্য ফ্রেঞ্চ সরকারকে অনুরোধ করা হয়।তাদের বক্তব্য ছিল - বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে দাবিয়ে রাখবার নীতিকে কোন মতেই সমর্থন করা যায় না।তারা আরো অনুরোধ করেন - শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের পরিমান যেন বাড়িয়ে দেয়া হয়।এর পাশাপাশি আলফ্রেড কাস্টলার বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার প্রতিবাদে লিখেছিলেন ফ্রান্সের লা ফিগারো পত্রিকাতে ৮ অক্টোবর,১৯৭১।সেই ছোট্ট লেখাটির একটি অনুবাদ প্রকাশ করে প্রথম আলো ১৮ মার্চ,২০১০।কাস্টলার বলেছিলেন -


এটা কী করে সম্ভব, এই ট্র্যাজেডি আমাদের চোখে পড়বে না। আমরা সম্পূর্ণ নির্বিকার থাকব, আমরা এই শিশুদের যন্ত্রণা কিছুমাত্র অনুভব করব না। এই শিশুদের মায়েদের হতাশার মুখোমুখি বিবেকহীন দাঁড়িয়ে থাকব?
মানবজাতির মুক্তির জন্য রোমে যে ধর্মসভা হয়ে থাকে তা কি এ অবস্থার পরও শান্তিপূর্ণভাবে চলতে থাকবে? এই অবস্থাকে বিবেচনায় না এনে যে ট্র্যাজেডি আমাদের সবার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে জাতিসংঘ কি কেবলই বকবক করে যাবে? বিবেক জাগাতে কোনো আঘাত কি আসবে না—এই গ্রহে মানুষের সংহতি দৃঢ় করতে?
মানবতা যদি নির্বিকারভাবে এই ট্র্যাজেডির কেবল সাক্ষী হয়েই থাকে, তাহলে নিজ থেকে এর ধ্বংসের সময় কি এখনো আসেনি?



বাল্টিমোর প্রতিরোধের কথা জানেন অনেকেই।সেইদিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মায় মার্কিন যুদ্ধাস্ত্র বোঝাইয়ে বাধা দেয়ার উদ্দেশ্যে যারা জড়ো হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু'জন ড. উইলিয়াম গ্রিনাফ এবং ড. ডেভিড নালিন - বাংলাদেশের অকৃত্রিম দুই বন্ধু।দুইজনই কাজের সূত্রে বাংলাদেশে থেকেছেন।১৯৭১ সালে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে চুপ করে থাকেননি তারা।এই দুইজনের সাথে ড. গ্রিনাফের স্ত্রী অ্যানা ব্রাউন টেইলর এবং প্রবাসী বাঙালী মহসীন সিদ্দিক মিলে গঠন করেন বাংলাদেশ ইনফর্মেশন সেন্টার (বিআইসি)।ড. গ্রিনাফ ছিলেন এই সংগঠনের সভাপতি।বিআইসির উদ্দেশ্য ছিল চারটি -

১) পাকিস্তানে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য পাঠানো বন্ধ করা
২) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা সংগঠিত গণহত্যার প্রতিবাদ
৩) শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য জনমত গঠন
৪) বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে গণমাধ্যমে কভারেজ বৃদ্ধি

বিআইসির উদ্যোগে শরণার্থীদের জন্য আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করা হয়।মাসিক সংগ্রহের পরিমানটা ৩০০০-৪০০০ ডলারের মতো ছিল।যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে বিআইসি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়।বোস্টন ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ,যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিরিশটির মতো প্রবাসী বাঙালীদের সংগঠনের সাথে যৌথভাবে কাজ করে তারা।যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি এবং প্রশাসনিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে লবিং চালিয়ে যায় বিআইসি।যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া বন্ধ করে যে বিল পাশ করা হয় তার পিছনে বিআইসির লবিং এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।


বিআইসির আরেকটি বড় সাফল্য ছিল নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন,যাতে প্রকাশিত হয়েছিল নিউজার্সিতে পাকিস্তানে পাঠানোর জন্য জাহাজে মার্কিন অস্ত্র বোঝাইয়ের খবর।এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবিটি সরবরাহ করা হয়েছিল বিআইসির আর্কাইভ থেকে।ড. গ্রিনাফের ভাষাতেই শুনুন -

One of the actions that was most embarrassing to Nixon and Kissinger was the front page story by Tad Szulc in the New York Times which showed photographs of weapons being shipped from New Jersey to Pakistan when the official position by the U.S.
government was that this was not happening. The documents listing the arms being
shipped were provided to Mr. Szulc by the BIC and he did a superb job of investigative
reporting to provide not only documentary, but photographic evidence for his articles


এর পাশাপাশি নিয়মিতভাবে গণহত্যার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে বিআইসি।এর অংশ হিসেবে হোয়াইট হাউজের সামনে অনশন শুরু করেন অ্যানা ব্রাউন টেইলর এবং ড. নালিন।অনশনের ছবি যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রভাবশালী পত্রিকায় প্রকাশিত মার্কিন জনগণের মানসিকতায় তার ব্যপক প্রভাব পড়ে।




ছবি : হোয়াইট হাউজের সামনে অনশনরত বিআইসি সদস্যরা - ( বাম দিক থেকে ) মিসেস মার্গারেট আইসেনম্যান এবং তার মেয়ে,অ্যানা ব্রাউন টেইলর এবং ড. ডেভিড নালিন

বিআইসির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ ছিল ওয়াশিংটন ডিসির থমাস সার্কেলে।এটি গুরত্বপূর্ণ এই কারণে - যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান এমব্যাসি ছিল এর কাছাকাছি।এরকম একটি জায়গায় প্রতিবাদ বেশ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিল।



ছবি : থমাস সার্কেলে প্রতিবাদরত বিআইসি সদস্যরা - ( বাম দিক থেকে ) নর্বার্ট হার্শন,ড. ডেভিড নালিন,অ্যানা ব্রাউন টেইলর, ( ডান দিক থেকে দাঁড়িয়ে ) মিসেস ডরোথি রাদারফোর্ড,মহসিন সিদ্দিক,ড. উইলিয়াম গ্রিনাফ, ( ডান দিক থেকে বসে ) ড. চার্লস কার্পেন্টার।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার একাত্তরের ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননা দেয়ার জন্য যেসব বিদেশী ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেছে তার মধ্যে ড. উইলিয়াম গ্রিনাফ,অ্যানা ব্রাউন টেইলর এবং ড. ডেভিড নালিন রয়েছেন।

এইভাবে সারা পৃথিবীর শান্তিকামী,বিবেচনাবান মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন,দাঁড়িয়েছেন মানবতার পক্ষে।নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে তারা নিরন্তর সমর্থন যুগিয়ে গিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের,বাঙালীদের।বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এমন অসংখ্য ব্যক্তির অসংখ্য অবদানের কাছে আমরা ঋনী।আমাদের ঋণ যেমন সেই মুক্তিযোদ্ধার কাছে যার করোটি ভেদ করে গিয়েছিল ঘাতকের বুলেট,ঠিক তেমনি ঋণ আছে সাড়ে নয় বছর গড় বয়সের সেইসব স্কুল ছাত্রীদের কাছে যারা সম্মিলিত উদ্যোগে ছাপ্পান্ন দশমিক পনেরো পাউন্ড স্টার্লিং সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিল অক্সফাম কর্তৃপক্ষের কাছে।যতদিন বাংলাদেশ থাকবে,বাঙালী বলে কোন জাতির অস্তিত্ব থাকবে পৃথিবীতে ততদিন আমাদের এই একান্ত সুহৃদদের নাম অভ্রস্পর্শী শ্রদ্ধা আর বুকভরা ভালোবাসায় উচ্চারিত হবে।

ঋণ শোধ করার সাধ্য নেই।আমার সর্বোচ্চ সামর্থ্যে যতটুকু কূলোয় ততটুকুই করে গেলাম - ঋণ স্বীকার।



তথ্যসূত্র :

১) মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র - মুনতাসীর মামুন
২) The Testimony of Sixty On Crisis of Bengal - Published by Oxfam
৩) গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ( দশম খণ্ড ) - হাসিনা আহমেদ
৪) The Bangladesh Information Center, Washington, DC 1971 - Wajeda J. Rab


( প্রথম প্রকাশ :

যুদ্ধাপরাধ ১৯৭১ - পর্ব দুই : হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ




১.


উধার আটঠো লাশ হ্যায়।কুত্তাছে খিলানা হ্যায়,খিলাদো।আউর না কিসিকো দেনা হ্যায় দে দো।যাও,যো তোমহারা মর্জি করো।


পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্পে চার মাস আটক থাকার পর সৌভাগ্যক্রমে ছাড়া পেয়ে যান যশোরের আমির হোসেন।ফেরার পথে একদল পাকিস্তানি সৈনিকের সাথে দেখা হয়ে যায় তার।তাদের একজন এই কথাগুলো বলেছিল আমির হোসেনকে।কিছুদর যেতেই তার চোখে পড়ে হাত পা বাঁধা উলঙ্গ আটটি লাশ।তাদের কারো কারো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা।

১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর - এসময় বাঙালিদের শুধু হত্যা করা হয়নি,হত্যার ধরণটা এমন ছিল যাতে মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় চিরতরে ভুলে যায় বাঙালি।সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে,অথবা শরণার্থীদের ভিড়ে আচমকা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে।হত্যা করা হয়েছে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে,কিংবা শাবলের বাড়িতে মাথা গুড়িয়ে দিয়ে।শিশুকে হত্যা করা হয়েছে ঘুমের ভেতরে,হত্যা করা হয়েছে হাসপাতালের অসুস্থ রোগীকে।সদ্যজাত শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ - কেউই বাদ যায়নি দশ মাসব্যাপী ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এই গণহত্যাযজ্ঞে।সমস্ত বাংলাদেশটাই ছিল একটা বধ্যভূমি।




ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানে শনাক্তকৃত বধ্যভূমির সংখ্যা ৯৪০ টি।এছাড়া ৬৫ টি ব্রিজ ও সেতু এবং ৮৮ টি নদীর সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে নিয়মিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চলতো।তাদের গবেষণা বলছে সারা বাংলাদেশের এরকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমির সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।


২.

এইসব হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী বিভিন্ন শক্তির দ্বারা।এসব অপরাধ গণহত্যা,যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ - তিনটিরই উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধগুলো সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক -

গণহত্যা
## হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে গণহত্যা সাধন
## সুপরিকল্পিত ভাবে শারীরিক ধ্বংস ও জীবননাশের মাধ্যমে গণহত্যা পরিকল্পনা এবং সংঘটন যা পরিনামে মানবজীবনকে নিশ্চিহ্ন করে

মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
## হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
## ব্যাপক নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ

যুদ্ধাপরাধ
## উদ্দেশ্য প্রণোদিত হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## শত্রু দেহ খন্ড বিখন্ড ও বিকৃত করণের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## খুনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## লক্ষ্যবস্তুর বাইরে ব্যক্তি ও বস্তুর উপর সীমাহীন আঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস,মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ

এগুলো ছাড়াও আরো কয়েকটি অপরাধ রয়েছে যা সুনির্দিষ্টভাবে হত্যার সাথে সম্পর্কিত নয়,তবে হত্যাকান্ড সেগুলোর উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।যেমন বেসামরিক ব্যক্তি ও স্থাপনার উপরে আঘাতের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ,সাধারণ জনগণের উপর আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী যতখানি দক্ষ ছিল সমরবিদ্যায়,সম্ভবত তার চেয়ে বেশি দক্ষ ছিল নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে।এধরণের হত্যাকান্ড অবশ্য সবসময়ই আগ্রাসী বাহিনীর জন্য একটি অনৈতিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজি।এসব হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় একদিকে যেমন প্রতিপক্ষের মনোবল দুর্বল করে দিতে,প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে।এছাড়া,আরো একটি কারণে এসময় এধরণের হত্যাযজ্ঞ গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল গেরিলা যুদ্ধের একটি চমৎকার উদাহরণ।এবং গেরিলাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র স্থানীয় জনগণের সাহায্য।বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সাধারণ মানুষ যাতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের সাহায্য না করে সেজন্য আতঙ্ক জিইয়ে রাখাটা খুব জরুরি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য।

হত্যাকান্ডগুলোর বিভিন্ন প্যাটার্ন দেখা যায়।শুধু প্রথাগত হত্যাকান্ড সংঘটন নয়,পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে প্রচুর 'ইমপ্রোভাইজেশন' এর আশ্রয় নিয়েছে,কথাটা অমানবিক শোনালেও একবিন্দু মিথ্যা নয়।হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের প্যাটার্ন গুলো একটু খেয়াল করলেই সেটা বোঝা যাবে।

## নিয়মিত ভাবে কোন এলাকার একটি নির্দিষ্ট স্থানে বাঙালিদের ধরে নিয়ে এসে হত্যা,যেমন ঢাকার মিরপুর,খুলনার গল্লামারী,চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ;
## শরণার্থীদের জমায়েতে আচমকা গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা,যেমন চুকনগর গণহত্যা ;
## বসতি এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ এবং হত্যা,যেমন জিঞ্জিরা গণহত্যা ;
## কোন এলাকায় আচমকা আচমকা হামলা চালিয়ে স্থানীয় মানুষদের ধরে এনে হত্যা,কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যা ;
## নিরাপদ জায়গায় পৌছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহুসংখ্যক মানুষকে একত্রিত করে হত্যা,যেমন সৈয়দপুরের গোলাহাট গণহত্যা
## কোন কারণ ছাড়াই বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে,মর্টার হামলা চালিয়ে হত্যা।এধরণের ঘটনা আসলে অসংখ্য ঘটেছে একাত্তরে।একটি ছোট উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে।বিয়ানীবাজারের কৃষক আবদুল ওয়াহিদ ১৫ ডিসেম্বর দিঘলবাক হাওড়ে ধান কাটার সময় সেখানে একটি মর্টার বিস্ফোরিত হলে নিহত হন আবদুল ওয়াহিদ ;
## গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে হত্যা,যেমন বুদ্ধিজীবী হত্যা,মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের তালিকা তৈরি করে বেছে বেছে হত্যা ;
## বন্দী নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা ;
## নারীদের ধর্ষণ ও বীভৎস নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা ;
## ক্রমাগত ধর্ষণের মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিতকরণ ;

এগুলো কয়েকটি নমুনা মাত্র,এছাড়াও হত্যাযজ্ঞ সাধনের বিভিন্ন প্যাটার্ন দেখা যায়।সেগুলো বিস্তারিত আলোচনায় আসবে।

হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের সময় যেসব পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে,হত্যার আগে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে সেসব দিকে একটু চোখ দেয়া যাক।পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং সহযোগীরা হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের ক্ষেত্রে কী ধরণের বিচিত্র পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল - সে ব্যাপারে এই অংশটি থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে -

## সন্দেহজনক ব্যক্তি দেখা মাত্র গুলি করা
## শক্তসমর্থ তরুণ ও যুবকদেরকে রাস্তা কিংবা বাড়িঘর থেকে বন্দী করে এনে চোখ বেঁধে সমষ্টিগতভাবে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে শারীরিক নির্যাতন করা এবং পরিশেষে পেছনে হাত বেঁধে কখনো এককভাবে কখনো কয়েকজনকে একসঙ্গে বেঁধে গুলি করে নদী জলাশয় বা গর্তে ফেলে দেয়া
## কখনো সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা
## কখনো নিকটজনের সামনেই বন্দীদেরকে এক এক করে জবাই করা এবং দেহ টুকরো করা
## সকলের সামনে বিভিন্ন অঙ্গচ্ছেদ করা অথবা বিভিন্ন অঙ্গে গুলি করে হত্যা করা
## চোখ উপড়ে ফেলা
## উলঙ্গ অবস্থায় উলটো করে ঝুলিয়ে রেখ পা থেকে মাথা পর্যন্ত চামড়া ছিলে ফেলা
## ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করে মাথা চূর্ণবিচূর্ণ করা এবং মুখ থেঁতলে ফেলা
## বস্তায় ঢুকিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা অথবা বস্তাবন্দী অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়া
## দড়ি দিয়ে বেঁধে লাথি ঘুষি ও অন্যান্য আঘাতের দ্বারা থেঁতলে রক্তাক্ত করে ফেয়া
## বাঁশ এবং রোলারের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চিপে ধরে থেঁতলে দেয়া এবং শেষে হত্যা
## বেয়নেট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে,কখনো পেটের সমস্ত নাড়িভুড়ি বের করে কিংবা বুক চিরে হৃৎপিন্ড উপড়ে ফেলা
## দড়ি দিয়ে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা
## পানি,অগ্নিকুন্ড কিংবা বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা করা
## ভিকটিমকে জবাই অথবা অন্যভাবে হত্যা করতে তার স্বজনদের বাধ্য করা
## নির্যাতনের পর শরীরে গুড় মাখিয়ে পিঁপড়ার গর্তে ফেলে দেয়া
## জীবন্ত মাটিচাপা দেয়া
## বন্দীদের হাত-পা বেঁধে রেললাইনের উপর শুইয়ে রেখে ট্রেনের ইঞ্জিন চালিয়ে দেয়া
## শিশুদেরকে আছড়ে মাটিতে ফেলে,বুটের নিচে পিষে শরীর থেঁতলে দেয়া ইত্যাদি


৩.

এবার কয়েকটি ঘটনা আলোচনা করা যাক।মনে রাখা প্রয়োজন এই ঘটনাগুলোর এত সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং সহযোগীদের নৃশংসতার মাত্রা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়,সেজন্য বিস্তারিত পাঠ এবং আলোচনা প্রয়োজন।এগুলো শুধুমাত্র সংঘটিত অপরাধের প্রকৃতি বোঝানোর জন্য কয়েকটি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে মাত্র।কেউ যেন ধরে না নেয় নির্যাতন,নৃশংসতা,হত্যার ভয়াবহতা এরকম কয়েকটি ঘটনার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল,বরং এগুলোর চেয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে ১৯৭১ সালে।সেগুলো সম্পর্কে প্রচুর পরিমানে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।

এছাড়া ধর্ষণ এবং অন্যান্য নারী নির্যাতন সংক্রান্ত ঘটনাগুলো আলাদাভাবে আলোচনা করা হবে অন্য পর্বে।

আরেকটি ব্যাপারে খেয়াল রাখার অনুরোধ করছি,প্রত্যেকটি হত্যাকান্ড সংঘটনের সাথে সাথে একাধিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।অনেক সময় একই ঘটনা একই সাথে গণহত্যা,যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের উপাদান হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।এজন্য প্রতিটি অপরাধের সাথে উদাহরণ হিসেবে আলোচনা না করে প্রতিটি ঘটনার বিবরণ শেষে সংঘটিত অপরাধগুলো চিহ্নিত করে দেয়া হবে।


খুলনার চুকনগর গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধকালে একদিনে সংঘটিত বৃহত্তম গণহত্যা।এইদিন ভারতগামী শরণার্থীদের একটি জমায়েতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় আনুমানিক দশ হাজার মানুষকে।গত শতকের গণহত্যার ইতিহাসে একদিনে একই স্থানে এত বেশি সংখ্যক মানুষকে একসাথে হত্যা করার উদাহরণ সম্ভবত আর নেই।দুঃখজনক হলেও সত্য,চুকনগর গণহত্যা একদিনে সংঘটিত বৃহত্তম গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি এখনো।এই নৃশংস হত্যাকান্ড নিয়ে যে পরিমান গবেষণা এবং অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন ছিল তা হয়নি।

চুকনগর গণহত্যার বিবরণ শোনা যাক প্রত্যক্ষ্যদর্শী এরশাদ আলী মোড়লের কাছ থেকে।এরশাদ আলীর পিতা চেকন আলো মোড়ল চুকনগর গণহত্যার প্রথম শহীদ।

চুকনগর বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূড়ে একটি রাস্তা আছে যেখান থেকে মালথিয়া গ্রামে যাওয়া যায়।ঐ গ্রামে আমার বাড়ি।১৯৭১ দলের ২০ মে বৃহস্পতিবার ৯-৩০ মিনিটের একটা মিলিটারির গাড়ি সাতক্ষীরার দিক থেকে চুকনগর আসে।ঐ গাড়িতে খান সেনা আর কিছু বাঙালি ছিল।

আমি আমার বাবা ও বড় ভাই একসাথে ঐ রাস্তার পাশে জমিতে হালচাষ করছিলাম।তখন মিলিটারির গাড়ি দেখে আমার নাম ধরে বললেন।' এরশাদ মিলিটারির গাড়ি আসছে,তাড়াতাড়ি পালিয়ে যা ' এই কথা বলার সাথে সাথে আমরা দৌড়ে দু'শ হাত দূরে আমাদের বাড়িতে চলে যাই।আমরা দূর থেকে দেখতে পেলাম খান সেনারা গাড়ী থেকে নেমে আমার বাবাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে।কিন্তু কি জিজ্ঞাসা করছিল তা আমরা জানতে পারিনি।আমরা দেখলাম আমার বাবা মিলিটারিদের মাথার উপর কাঁচি দিয়ে মারতে যাচ্ছেন।এ সময় তারা বাবাকে গুলি করে।গুলি করার আগে বাবা চিৎকার করে বলে ওঠেন, ' তোরা পালা। ' তখন আমরা নিজেদের বাড়ি থেকে আরও দূরে সরে যাই।

এর পর মিলিটারিরা রাস্তার অপর সাইডে চলে গেল এবং বটিয়াঘাটা,দাকোপ,ছিয়ানব্বই গ্রাম ইত্যাদি এলাকা থেকে আগত হাজার হাজার শরণার্থীর উপর নির্বিচারে গুলি করতে লাগলো।মিলিটারিরা প্রথমে মালথিয়া গ্রামে এসে আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে তাদের হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে।আমরা দেখতে পেলাম মেশিন গানের ব্রাশফায়ারে হাজার হাজার মানুষ পাখির মতো পড়ে যেতে লাগলেন।বৃদ্ধ মহিলা পুরুষসহ আনুমানিক ২ থেকে ৩ হাজার মানুষ সেখানে তারা হত্যা করে।

... এরপর মিলিটারিরা ওখানকার একটি রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিকে যায় এবং সেখান থেকে চুকনগর বাজারে যেয়ে গুলি করে।বাজারে তাদের গুলিতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হন।চুকনগর সরদার বাড়ি ও অন্যান্য এলাকার প্রায় চার হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করে পাকি আর্মিরা।সকাল সাড়ে ন'টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত তারা অবিরাম গুলি চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে।সাতক্ষীরা থেকে প্রথমে এক গাড়ি পাকি আর্মি আসে,পরে আরো দু'গাড়ি আর্মি এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।এরপর হত্যাযজ্ঞ শেষ হলে তারা গাড়িসহ সাড়ে তিনটায় সাতক্ষীরার দিকে চলে যায়।

... ২০-২৫ টা করে লাশ প্রতিদিন ঘ্যাংরাইল নদীতে আমরা টেনে ফেলেছি।চার পাঁচদিন যাবত আমরা এই কাজ করি।আর চুকনগরে যে লাশ পড়েছিল তা সব ভদ্রা নদীতে ফেলা হয়।


চুকনগর গণহত্যা সংঘটনকালে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলো হলো -

## হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে গণহত্যা সাধন
## ব্যাপক নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
## লক্ষ্যবস্তুর বাইরে ব্যক্তি ও বস্তুর উপর সীমাহীন আঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস,মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ

প্রায় একই ধরণের আরেকটি হত্যাকান্ড ঘটেছিল কিশোরগঞ্জের বরইতলায়।তবে প্রকৃতিগতভাবে এটি আরো ভয়ঙ্কর।নৃশংসতার দিক দিয়ে বরইতলা গণহত্যার তুলনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন।১৩ অক্টোবর,১৯৭১ বরইতলা গ্রামের রেল লাইনের পাশে এই হত্যাকান্ড ঘটে।এই ঘটনার বিবরণ শোনা যাক প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর রাজ্জাকের কাছ থেকে -

এসময় প্রায় দেড় হাজারের মত লোককে তারা সেখানে জড়ো করে।সেখান থেকে কয়েক জনকে ধরে জিওল গাছের নিচে নিয়ে গিয়ে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে।যাদেরকে আঘাত করা হয় তাদের আঘাতের স্থানগুলো ফুলে ওঠে।তখন পাকি আর্মিরা শরীরের ফুলে ওঠা অংশগুলো চাকু দিয়ে ফেড়ে দিতে থাকে।আমি এগুলো দেখতে গেলে আমাকে থাপ্পর মারে ও লাঠি দিয়ে আঘাত করে।ঠিক এসময় গ্রামের আলবদর আব্দুল হাশিম পাকি ও আর্মিদের খবর দে যে, 'মুক্তিবাহিনী এক পাকি সেনাকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে।' এ কথা শোনার পর সেখানে অবস্থানরত পাকি মেজর সবার হাত পা বেঁধে ফেলার নির্দেশ দেয়।তখন অনেকে বয়ে দৌড়ে মসজিদে যেয়ে ঢোকেন।যাদের গ্রামে রাজাকার ছিল তাদের অনেককে এসময় ছেড়ে দেয়া হয়।প্রায় ৫০০ জন মানুষকে এভাবে হত্যার জন্য দাঁড় করানো হল।তখন আমরা সবাই "লা ইলাহা ইল্লালাহু,মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ " বলে জোরে জোরে কলেমা পড়তে লাগলাম।তখন মেজর বলল, 'এভাবে কলেমা পড়তে থাকলে তো মারা যাবে না।' তারপর তারা ৩০ কেজি ওজনের রেললাইন ঠিক করা শাবল দিয়ে জনতার প্রথম সারি থেম এমাথায় আঘাত করা শুরু করে।এতে অধিকাংশ লোকের মাথা চৌচির হয়ে হয়ে তাদের রক্তমিশ্রিত ঘিলু ছিটকে পড়ে।অনেকে কাধ ও ঘাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন।এ সময় লাইন যারা ভয়ে দৌরে পালাচ্ছিলেন তাদের কাউকে কাউকে জোর করে ধরে এনে বেত দিয়ে পিটিয়ে পুনরায় দাঁড় করানো হচ্ছিল,কাউকে কাউকে আবার গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল।যাদেরকে শাবল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করতে পারেনি,তাদেরকএ শেষে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।


... সেদিন যে ৫০০ জনের উপর নির্যাতন চালানো হয় তার মধ্যে ৩৬৬ জন মারা যান।বাকিরা আহত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন।এর মধ্যে কেউ কেউ পরে মারা যান।


সংঘটিত অপরাধসমূহ -

## হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে গণহত্যা সাধন
## ব্যাপক নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
## লক্ষ্যবস্তুর বাইরে ব্যক্তি ও বস্তুর উপর সীমাহীন আঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস,মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## শত্রু দেহ খন্ড বিখন্ড ও বিকৃত করণের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ

সৈয়দপুরের গোলাহাট গণহত্যাও প্রকৃতিগত ভাবে অনেকটা একইরকম।তবে এক্ষেত্রে আরো একটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে - সুপরিকল্পিত ভাবে শারীরিক ধ্বংস ও জীবননাশের মাধ্যমে গণহত্যা পরিকল্পনা এবং সংঘটন যা পরিনামে মানবজীবনকে নিশ্চিহ্ন করে

১৩ জুন পাকিস্তান আর্মি সৈয়দপুরের ১৫০ জন লোককে ক্যান্টনমেন্টের ধরে নিয়ে যায়।এরপর তাদেরকে ভারতে পৌছে দেয়ার নাম করে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনে হয়।কৌশলে বন্দীদের পরিবারের সদস্যদেরও স্টেশনে আনা হয়।এই ফাঁকে চালানো হয় নির্বিচার লুটপাট।ট্রেনের চারটি বগির পেছনের দুটোতে উঠানো হয় নারী ও শিশুদের;বাকি দুটোতে পুরুষদের।দু'কিলোমিটার যাবার পর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের একটি কালভার্টে এসে ট্রেনটি থেমে যায়।তারপরই শুরু হয় বীভৎস হত্যাযজ্ঞ।একজন একজন করে নামানো হয়,আর খোলা তলোয়ারের কোপে দু'খন্ড কর ফেলা হয় তাদের দেহ।জানালা ভেঙ্গে যারা পালাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।গোলাহাটে পাকিস্তানিদের এই হত্যাকান্ড থেকে সেইদিন তেইশজন পুরুষ পালাতে সক্ষম হলেও নারী ও শিশুদের মধ্যে কেউ পালাতে পারেনি।উপর্যুপরি ধর্ষণ শেষে নারীদেরও হত্যা করা হয়।ঐদিন গোলাহাটে পাকিস্তানি সেনারা ৪১৩ জনকে হত্যা করে।

এই হত্যাকান্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে স্থানীয় বিহারিদের একাংশ।বাঙালি ছাড়াও এদিন সৈয়দপুরে বসবাসকারী অনেক মাড়োয়ারি নিহত হয়।গোলাহাট গণহত্যা নিয়ে ১৯ অগাস্ট নিউইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় -


শত্রু দেহ খন্ড-বিখন্ড করে,পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার আরো একটি ঘটনা ঘটে ৩০ এপ্রিল,১৯৭১,পাকশী রেলস্টেশনে।এদিন আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আঠারো জনকে ধরে নিয়ে এসে জড়ো করা হয় পাকশী স্টেশনের ওয়েটিং রুমে।বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন করার পর রাতে তাদের নিয়ে আসা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপরে।তাদের হাত পা বেঁধে রেললাইনের উপরে শুইয়ে দেয়া হয়।এবং সবশেষে তাদের শরীরের উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়া হয় ট্রেনের ইঞ্জিন।ছিন্নভিন্ন লাশগুলো নিচে পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

এরকম আরো একটি ঘটনা জানা যায় খুলনার মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল কাইয়ুমের কাছ থেকে।ঘটনাটি কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটির।প্রচন্ড এক যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটিটি দখল করার পর সেখানকার একটি কক্ষে সৈয়দ গাজী নামক একজন মুক্তিযোদ্ধার দেহ পাওয়া যায়,তিনি রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়ে বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য পাচার করতেন।রাজাকারেরা তার প্রকৃত পরিচয় জেনে যাবার পর তার সমস্ত শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সেই কাটা জায়গায় লবন লাগিয়ে দেয়।এর পরে হাতে পায়ে পেরেক ঠুকে দেয়ালে আটকে রাখে।সৈয়দ গাজী হয়ে যান বাস্তব একাত্তরের যীশু।

কপিলমুনির এই ঘটনায় যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে -

## শত্রু দেহ খন্ড বিখন্ড ও বিকৃত করণের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## খুনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ

সুপরিকল্পিতভাবে শারীরিক ধ্বংস ও মানসিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে গণহত্যা সাধনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ অপারেশন সার্চলাইট।একটু আলোচনা করলেই বোঝা যাবে।বাঙালি জাতিকে শেঁকড় শহ নির্মূল করার এই পরিকল্পনাটি শুরু হয় একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতেই।২২ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া,জেনারেল পীরজাদা,জেনারেল মিটঠা ও জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া - এরা সবাই মিলে আওয়ামীলীগ সমর্থকদের গুঁড়িয়ে দিতে একটি ব্যাপক গণহত্যার পরিকল্পনা করে।সেসময় এ সংক্রান্ত কিছু চালাচালিও হয়েছিল।তবে চূড়ান্ত আঘাতের পরিকল্পনাটি করে জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও জেনারেল রাও ফরমান আলী খান।তারা ঢাকা জিওসির অফিসে বসে এটা তৈরি করে।মূল অপারেশন পরিকল্পনা তৈরি করে রাও ফরমান আলী।জিওসির অফিসে একটি নীল কাগজের ওপরে কাঠপেন্সিল দিয়ে রচিত হয় ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যার পরিকল্পনা।৭১ এর ২০ মার্চ ১৬ প্যারা সম্বলিত পাঁচ পৃষ্ঠার অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনাটি জেনারেল টিক্কা ও জেনারেল হামিদের কাছে পেশ করা হয় অনুমোদনের জন্য।সামান্য কিছু রদবদল করে পরিকল্পনাটি অনুমোদিত হয়ে যায়।

এরপর জেনারেল খাদিম ও জেনারেল ফরমান আলী পূর্ব বাংলার বিভিন্ন ব্রিগেড কমান্ডার যেমন - যশোরের ব্রিগেডিয়ার দুররানি,কুমিল্লার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল সফি,চট্টগ্রামের লে. কর্নেল ফাতিমী এবং সিলেট,রংপুর,রাজশাহীর ব্রিগেড কমান্ডারদের অবহিত করে।৫৭ ব্রিগেড কমান্দার ব্রিগেডিয়ার আরবাব ঢাকা শহর ও শহরতলী অপারেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করে।আর কেজর খাদিম হোসেন রাজা পুরো বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞের দায়িত্ব পায়।ঐ সময় মেজর জেনারেল ইফিতেখার জানজুয়া এবং জেনারেল মিটঠা গণহত্যা এবং সশস্ত্র বাঙালি দমনে সহায়তা দিতে বাংলাদেশেই ছিল।ঢাকা শহরের বস্তি ও বাড়িঘরগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দেবার দায়িত্ব পেয়েছিল ক্যাপ্টেন সাইদ।

হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের উদাহরণ - বুদ্ধিজীবী হত্যা।বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে পঙ্গু করে দিতে সারাদেশের প্রসাসনিক কর্মকর্তা,সিভিল সার্জন,অধ্যাপক,শিক্ষক,সাহিত্যিক সাংবাদিক,ডাক্তার,প্রকৈশলী সহ শিক্ষিত শ্রেণির মানুষদের বেছে বেছে,তালিকা তৈরি করে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই।

২৬ মার্চ সকালে ঢাকা বশ্বাবিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একজন হাউজ টিউটর অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে আরও দু'জনের সাথে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়।ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের রিডার এএনএম মুনিরুজ্জামানকে তার পরিবারের তিন সদস্যসহ শহীদ মিনার সংলগ্ন ৩৪ নম্বর বাড়িতে হত্যা করা হয়।অধ্যাপক জি সি দেব,জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকেও গুলি করা হয় সেদিন।জি সি দেব তাতক্ষণিকভাবে মারা যান,২৭ মার্চ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালে নেয়া হয়,তারপর মারা যান তিনি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাটি তৈরি করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিসংখ্যান বিভাগের কাজী সালেহ,গণিত বিভাগের প্রভাষক মুজিবর রহমান,ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের ড. রফিক এবং বাংলা বিভাগের ড. আবু হেন আমোস্তফা কামালকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালায়।ততকালীন উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন এ ব্যাপারে তালিকা তৈরি করতে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে।সংস্কৃত ভাষার সহকারী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে হত্যা করে একটি গর্তে ফেলে রাখা হয়।হত্যা করা হয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মীর আব্দুল কাইয়ুমকে,গণিত বিভাগের অধ্যাপক হবিবুর রহমানকে।

মে মাসেই বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা নেয়া হয়েসময় ইয়াহিয়া সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ ফর্ম পাঠানো হয় কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর কাছে,মনে করা হয় এদের সম্পর্কে তল্লাশির উদ্দেশ্যেই এই ফর্ম পাঠানো হয়।লন্ডন টাইমস পত্রিকা এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দিলে,পরিকল্পনা তখনকার মত স্থগিত রাখা হয়।

একাত্তরের শেষার্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী শক্তি,মূল পরিকল্পনা করে রাও ফরমান আলী।ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকা শহর জামাতে ইসলামীর দফতর সম্পাদক এবিএম খালেক মজুমদারকে।অক্টোবর থেকে আলবদর বাহিনী এই হত্যাযজ্ঞের প্রস্তুতি নেয়,নভেম্বর থেকে অনেক বুদ্ধিজীবীদের কাছে তারা হুশিয়ারি পত্র পাঠাতে থাকে।

ঢাকার মিরপুর,মোহাম্মদপুর থানা এলাকার ব্রিগেডিয়ার রাজা,রমনা থানা এলাকার ব্রিগেডিয়ার আসলাম,তেজগাঁও এলাকার ব্রিগেডিয়ার শরীফ এবং ধানমন্ডি এলাকার ব্রিগেডিয়ার শফি ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যায় বিশেষ ভূমিকা রাখে।বুদ্ধিজীবী হত্যার অপারেশন ইন চার্জ ছিল চৈধুরি মঈনউদ্দিন,প্রধান ঘাতক ছিল আশরাফুজ্জামান।আশরাফুজ্জামান মিরপুর গোরস্থানে সাতজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে।জানা যায়,ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য পাঁচশ আলবদর সদস্যকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।আশরাফুজ্জামানের একটি ডায়েরির দুটি পৃষ্ঠায় ১৯ জন বিশিষ্ট শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক গোলাম মর্তুজার নাম ও ঠিকানার উল্লেখ ছিল।এই বিশজনের মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর আটজন নিখোঁজ হন।তারা হলেন- অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী,অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরি,অধ্যাপক আনোয়ার পাশা,ড. আবুল খায়ের,অধ্যাপক রশীদুল হাসান,অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহমেদ,ড. ফয়জুল মহী ও ডা. মুর্তজা।

১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় বুদ্ধীজীবী হত্যার দ্বিতীয় অধ্যায়।এর প্রথম শিকার ছিলেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন।এর পরপরই নিখোঁজ হতে থাকেন অনেকে।তাদের অনেকেরই লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে,১৮ ডিসেম্বর।কারো লাশ পাওয়া যায় মিরপুর বধ্যভূমিতে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরো কিছু জায়গায়।৫ জানুয়ারি মিরপুর গোরস্থানে পাওয়া যায় সন্তোষ ভট্টাচার্য,ড. সিরাজুল হক,ড. ফয়জুল মহী ও ডা. মুর্তজার লাশ।দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন,সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার,সাবের পিআইএ এর ব্যুরো চীফ ও বিবিসি সংবাদদাতা নিজামুদ্দিন আহমেদ ও চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হকের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনাগুলো উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের উপাদান হিসেবেও গণ্য হবে।

নিচের বিবরণটি লক্ষ্যবস্তুর বাইরে ব্যক্তি ও বস্তুর উপর সীমাহীন আঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস,মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের একটি নমুনা।এটি জানা যায় ঢাকার উত্তরার সালেহা বেগমের কাছ থেকে।

৮ ডিসেম্বর রাতে ভয়ঙ্কর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল।তখন শুনতে পেলাম তেজগাঁওতে বোম্বিং করা হচ্ছে।তেজগাঁওতে আমাদের সব মালামাল ও গরু বাছুর থাকায় সকালে পায়ে হেঁটে পুনরায় তেজগাঁও আসলাম।রাস্তায় দেখলাম মানুষজন ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।কোন যানবাহন তখন রাস্তায় ছিল না।সেখানে গিয়ে শুনলাম তেজগাঁও এতিমখানায় বোম্বিং করা হয়েছে,কি ঘটেছে তা দেখার জন্য পায়ে হেঁটে এতিমখানার সামনে গেলাম।সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে গেল,ধ্বংসস্তুপের মাঝে কতগুলো এতিম শিশুর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ পরে আছে।


৪.

উপরের ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী শক্তির দ্বারা হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের কয়েকটি নমুনা মাত্র।এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে সেসময়,সারা বাংলাদেশেই।গণহত্যার ভয়াবহতা এবং হত্যাকান্ডের নির্মমতা বুঝতে,মানবিকতার বিপর্যয়ের মাত্রা বুঝতে এরকম আরো কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হল।

সালেমা বেগমের কাছ থেকেই জানা যাক একটি শিশুহত্যা এবং একজন অপ্রকৃতিস্থ বৃদ্ধের বিবরণ -

একটা ছোট বাচ্চা ছেলে ওই বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা নাড়ছিল ও মুখে জয়বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছিল।এই 'জয়বাংলা' শব্দটা পাকিস্তানি আর্মির কানে যাবার সাথে সাথে তারা ওই বাসার দোতলাইয় উঠে যায়।বাচ্চাটার হাতে তখনও পতাকাটা ধরা ছিল।হানাদাররা প্রথমে পতাকাটা ছিনিয়ে নিয়ে ছেলেটার মাথার মধ্যে পতাকার লাঠিটা ঢুকিয়ে দেয়।বাচ্চাটি তখন যন্ত্রণায় মাটিতে পরে যায়।এসময় ছেলেটার মা,বাবা ও দাদা,দাদী সেখানে ছুটে আসেন।আর্মিরা বাচ্চাটির বাবা ও দাদাকে বেঁধে রেখে তাদের সামনেই মা ও দাদীকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে।ধর্ষণ শেষে বাবা ও দাদাকে গুলি করে হত্যা করে।

... এই বৃদ্ধ,তার ছেলে ও নাতি তিনজনকে আর্মিরা বলে, 'তোমাদের মারবো না,তোমরা এই পুকুর পাড়ে চলে এসো' ।তারা তিনজন পুকুর পাড়ে চলে আসলে তাদেরকে সেই বিশাল পুকুর এপার থেকে সাঁতরে ওপার হয়ে ফিরে আসতে পারলে হত্যা করা হবে না বলে আর্মিরা জানায়।তখন তারা তিনজন প্রথমবার সাঁতরে ফিরে আসলে তাদেরকে দ্বিতীয়বার সাঁতরিয়ে আসতে বলে।দ্বিতীয়বার সাঁতরে আসলে তাদেরকে তৃতীয়বার সাঁতরে ফিরে আসার জন্য বলা হয়।তৃতীয়বার সাঁতরে আসলে তাদেরকে চতুর্থবার সাঁতরে ফিরে আসার জন্য বলা হয়।তারা তখন খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন।কিন্তু জীবনা বাঁচানোর তাগিদে তারা মরিয়া হয়ে সাঁতরাচ্ছিলেন।আসলে পাকিস্তানী আর্মিরা তাদের জীবন নিয়ে স্রেফ কৌতুক করছিল।চতুর্থবার যখন সাঁতরিয়ে কোনরকমে মাঝপুকুরে যান তখন তাদের উপর আর্মিরা ব্রাশফায়ার করে।এই ব্রাশফায়ারে ওই বৃদ্ধের ছেলে ও নাতি নিহত হন।কিন্তু বৃদ্ধ ব্যক্তিটি আহত অবস্থায় বেঁচে যান।পরে নাতি ও ছেলের শোকে তিনি পাগল হয়ে যান।


বিয়ানীবাজারের ময়না মিয়াকে বাধ্য করা হয় তার পরিচত জন রুপীচরণ দাসকে জবাই করতে।হিন্দু বলে তাকে হত্যা করতে কোন গুলি খরচ না করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানি সৈনিকেরা।ময়না মিয়াকে ডেকে নির্দেশ দেওয়া হয় ধান কাটার কাস্তে দিয়ে রুপীচরণকে জবাই করতে।ময়না মিয়া গলা কাটার ভান করেন কাস্তের উলটো দিক দিয়ে।তাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকার ভান করতে বলেন।কিন্তু ময়না মিয়া কিছুদূর চলে যাবার পর রুপীচরণ দাস মাথা তুলে দেখতে যান সৈন্যরা চলে গেছে কি না।এটা দেখে ফেলে তারা।তখন আবার ময়না মিয়াকে ডেকে এনে বুকে বন্দুক ধরে বাধ্য করা হয় জবাই করতে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বিয়ানী বাজারের ঢেউনগর গ্রামে হামলা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী।এসময় তারা বারিন্দ্র নমশূদ্রকে পেয়ে যায় গ্রামের কালাচাঁদ মন্দিরের কাছে।দেখা মাত্রই গুলি করা হয় তাকে।গুলি তার বুক ফুড়ে বেরিয়ে যায়।তারপরও তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য কাছে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করা হয়।কুশিয়ারা নদীতীরে ফেলে রাখা হয় তার লাশ।শেয়াল-কুকুর-শকুনের টানাটানির পরে একসময় তার লাশ বানের পানিতে ভেসে যায়।

নিউজউইক পত্রিকায় ২ অগাস্ট ১৯৭১, BENGAL : THE MURDER OF A PEOPLE শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।এখান থেকে একটি ঘটনা জানা যায়,শরীর থেকে ক্রমাগত রক্ত বের করে নিয়ে হত্যা করার একটি ঘটনা -

Assembling the young men of the village of Haluaghat in East Pakistan,a Pakistani Army major informed them that his wounded soldiers urgently needed blood.Would they be donor?The young men lay down on makeshift cots,needles were inserted in their veins,and then slowly the blood was drained from their bodies until they died.



৫.

এখানে উল্লিখিত ঘটনার মত আরো হাজার হাজার ঘটনা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দশটি মাসে।১৯৭১ সালে সমস্ত বাংলাদেশই ছিল একটি মাইলাই,সমস্ত বাংলাদেশই ছিল একটি অখন্ড বধ্যভূমি।পরিকল্পিত এই গণহত্যা সুনির্দিষ্টভাবে পরিচালিত হয় বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে,বাঙালি জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে।গণহত্যার এইসব বিবরণের বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন।পাঠ্যবইয়ে লেখা 'তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' জাতীয় দুই একটি বাক্য দিয়ে দায় সারার চেষ্টা নিতান্তই হাস্যকর শোনায়।

এই পর্বে হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা হল।আগামী পর্বে নারী নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধসমূহ আলোচনা করা হবে।



তথ্যসুত্র
১) যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ - ডা. এম এ হাসান
২) '৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ - ডা. এম এ হাসান
৩) একাত্তরের গণহত্যা : রাজধানী থেকে বিয়ানীবাজার - আজিজুল পারভেজ
৪) একাত্তর : নির্যাতনের কড়চা - আতোয়ার রহমান
৫) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে শত্রুমিত্র - সিরু বাঙালি
৬) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ( অষ্টম খন্ড ) - হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত

কৃতজ্ঞতা
অমি রহমান পিয়াল
এম এম আর জালাল

( প্রথম প্রকাশ :