১.
উধার আটঠো লাশ হ্যায়।কুত্তাছে খিলানা হ্যায়,খিলাদো।আউর না কিসিকো দেনা হ্যায় দে দো।যাও,যো তোমহারা মর্জি করো।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্পে চার মাস আটক থাকার পর
সৌভাগ্যক্রমে ছাড়া পেয়ে যান যশোরের আমির হোসেন।ফেরার পথে একদল পাকিস্তানি
সৈনিকের সাথে দেখা হয়ে যায় তার।তাদের একজন এই কথাগুলো বলেছিল আমির
হোসেনকে।কিছুদর যেতেই তার চোখে পড়ে হাত পা বাঁধা উলঙ্গ আটটি লাশ।তাদের কারো
কারো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর - এসময় বাঙালিদের শুধু হত্যা করা
হয়নি,হত্যার ধরণটা এমন ছিল যাতে মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় চিরতরে ভুলে যায়
বাঙালি।সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে,অথবা শরণার্থীদের
ভিড়ে আচমকা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে।হত্যা করা হয়েছে বেয়নেট দিয়ে
খুঁচিয়ে,কিংবা শাবলের বাড়িতে মাথা গুড়িয়ে দিয়ে।শিশুকে হত্যা করা হয়েছে
ঘুমের ভেতরে,হত্যা করা হয়েছে হাসপাতালের অসুস্থ রোগীকে।সদ্যজাত শিশু থেকে
অশীতিপর বৃদ্ধ - কেউই বাদ যায়নি দশ মাসব্যাপী ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এই
গণহত্যাযজ্ঞে।সমস্ত বাংলাদেশটাই ছিল একটা বধ্যভূমি।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানে শনাক্তকৃত
বধ্যভূমির সংখ্যা ৯৪০ টি।এছাড়া ৬৫ টি ব্রিজ ও সেতু এবং ৮৮ টি নদীর সন্ধান
পাওয়া গেছে যেখানে নিয়মিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চলতো।তাদের গবেষণা বলছে সারা
বাংলাদেশের এরকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমির সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে
যাবে।
২.
এইসব হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তান
সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী বিভিন্ন শক্তির দ্বারা।এসব অপরাধ
গণহত্যা,যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ - তিনটিরই উপাদান হিসেবে
কাজ করেছে।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধগুলো
সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক -
গণহত্যা
## হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে গণহত্যা সাধন
## সুপরিকল্পিত ভাবে শারীরিক ধ্বংস ও জীবননাশের মাধ্যমে গণহত্যা পরিকল্পনা এবং সংঘটন যা পরিনামে মানবজীবনকে নিশ্চিহ্ন করে
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
## হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
## ব্যাপক নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
যুদ্ধাপরাধ
## উদ্দেশ্য প্রণোদিত হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## শত্রু দেহ খন্ড বিখন্ড ও বিকৃত করণের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## খুনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## লক্ষ্যবস্তুর বাইরে ব্যক্তি ও বস্তুর উপর সীমাহীন আঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস,মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
এগুলো ছাড়াও আরো কয়েকটি অপরাধ রয়েছে যা সুনির্দিষ্টভাবে হত্যার সাথে
সম্পর্কিত নয়,তবে হত্যাকান্ড সেগুলোর উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।যেমন
বেসামরিক ব্যক্তি ও স্থাপনার উপরে আঘাতের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ,সাধারণ
জনগণের উপর আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী যতখানি দক্ষ ছিল সমরবিদ্যায়,সম্ভবত তার চেয়ে বেশি
দক্ষ ছিল নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে।এধরণের হত্যাকান্ড অবশ্য সবসময়ই আগ্রাসী
বাহিনীর জন্য একটি অনৈতিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজি।এসব হত্যাযজ্ঞ
চালানো হয় একদিকে যেমন প্রতিপক্ষের মনোবল দুর্বল করে দিতে,প্রতিপক্ষকে চাপে
রাখতে তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে।এছাড়া,আরো একটি কারণে
এসময় এধরণের হত্যাযজ্ঞ গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর
জন্য।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল গেরিলা যুদ্ধের একটি চমৎকার উদাহরণ।এবং
গেরিলাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র স্থানীয় জনগণের সাহায্য।বাংলাদেশের প্রত্যন্ত
অঞ্চলগুলোতে সাধারণ মানুষ যাতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের সাহায্য না করে
সেজন্য আতঙ্ক জিইয়ে রাখাটা খুব জরুরি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য।
হত্যাকান্ডগুলোর বিভিন্ন প্যাটার্ন দেখা যায়।শুধু প্রথাগত হত্যাকান্ড সংঘটন
নয়,পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে প্রচুর 'ইমপ্রোভাইজেশন' এর আশ্রয়
নিয়েছে,কথাটা অমানবিক শোনালেও একবিন্দু মিথ্যা নয়।হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের
প্যাটার্ন গুলো একটু খেয়াল করলেই সেটা বোঝা যাবে।
## নিয়মিত ভাবে কোন এলাকার একটি নির্দিষ্ট স্থানে বাঙালিদের ধরে নিয়ে এসে
হত্যা,যেমন ঢাকার মিরপুর,খুলনার গল্লামারী,চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে
সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ;
## শরণার্থীদের জমায়েতে আচমকা গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা,যেমন চুকনগর গণহত্যা ;
## বসতি এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ এবং হত্যা,যেমন জিঞ্জিরা গণহত্যা ;
## কোন এলাকায় আচমকা আচমকা হামলা চালিয়ে স্থানীয় মানুষদের ধরে এনে হত্যা,কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যা ;
## নিরাপদ জায়গায় পৌছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহুসংখ্যক মানুষকে একত্রিত করে হত্যা,যেমন সৈয়দপুরের গোলাহাট গণহত্যা
## কোন কারণ ছাড়াই বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে,মর্টার হামলা চালিয়ে
হত্যা।এধরণের ঘটনা আসলে অসংখ্য ঘটেছে একাত্তরে।একটি ছোট উদাহরণ দিলে বোঝা
যাবে।বিয়ানীবাজারের কৃষক আবদুল ওয়াহিদ ১৫ ডিসেম্বর দিঘলবাক হাওড়ে ধান কাটার
সময় সেখানে একটি মর্টার বিস্ফোরিত হলে নিহত হন আবদুল ওয়াহিদ ;
## গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে হত্যা,যেমন বুদ্ধিজীবী
হত্যা,মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের তালিকা তৈরি করে বেছে বেছে হত্যা ;
## বন্দী নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা ;
## নারীদের ধর্ষণ ও বীভৎস নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা ;
## ক্রমাগত ধর্ষণের মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিতকরণ ;
এগুলো কয়েকটি নমুনা মাত্র,এছাড়াও হত্যাযজ্ঞ সাধনের বিভিন্ন প্যাটার্ন দেখা যায়।সেগুলো বিস্তারিত আলোচনায় আসবে।
হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের সময় যেসব পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে,হত্যার আগে যেভাবে
নির্যাতন করা হয়েছে সেসব দিকে একটু চোখ দেয়া যাক।পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং
সহযোগীরা হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের ক্ষেত্রে কী ধরণের বিচিত্র পদ্ধতি ব্যবহার
করেছিল - সে ব্যাপারে এই অংশটি থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে -
## সন্দেহজনক ব্যক্তি দেখা মাত্র গুলি করা
## শক্তসমর্থ তরুণ ও যুবকদেরকে রাস্তা কিংবা বাড়িঘর থেকে বন্দী করে এনে চোখ
বেঁধে সমষ্টিগতভাবে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে শারীরিক
নির্যাতন করা এবং পরিশেষে পেছনে হাত বেঁধে কখনো এককভাবে কখনো কয়েকজনকে
একসঙ্গে বেঁধে গুলি করে নদী জলাশয় বা গর্তে ফেলে দেয়া
## কখনো সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা
## কখনো নিকটজনের সামনেই বন্দীদেরকে এক এক করে জবাই করা এবং দেহ টুকরো করা
## সকলের সামনে বিভিন্ন অঙ্গচ্ছেদ করা অথবা বিভিন্ন অঙ্গে গুলি করে হত্যা করা
## চোখ উপড়ে ফেলা
## উলঙ্গ অবস্থায় উলটো করে ঝুলিয়ে রেখ পা থেকে মাথা পর্যন্ত চামড়া ছিলে ফেলা
## ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করে মাথা চূর্ণবিচূর্ণ করা এবং মুখ থেঁতলে ফেলা
## বস্তায় ঢুকিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা অথবা বস্তাবন্দী অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়া
## দড়ি দিয়ে বেঁধে লাথি ঘুষি ও অন্যান্য আঘাতের দ্বারা থেঁতলে রক্তাক্ত করে ফেয়া
## বাঁশ এবং রোলারের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চিপে ধরে থেঁতলে দেয়া এবং শেষে হত্যা
## বেয়নেট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে,কখনো পেটের সমস্ত নাড়িভুড়ি বের করে কিংবা বুক চিরে হৃৎপিন্ড উপড়ে ফেলা
## দড়ি দিয়ে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা
## পানি,অগ্নিকুন্ড কিংবা বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা করা
## ভিকটিমকে জবাই অথবা অন্যভাবে হত্যা করতে তার স্বজনদের বাধ্য করা
## নির্যাতনের পর শরীরে গুড় মাখিয়ে পিঁপড়ার গর্তে ফেলে দেয়া
## জীবন্ত মাটিচাপা দেয়া
## বন্দীদের হাত-পা বেঁধে রেললাইনের উপর শুইয়ে রেখে ট্রেনের ইঞ্জিন চালিয়ে দেয়া
## শিশুদেরকে আছড়ে মাটিতে ফেলে,বুটের নিচে পিষে শরীর থেঁতলে দেয়া ইত্যাদি
৩.
এবার কয়েকটি ঘটনা আলোচনা করা যাক।মনে রাখা প্রয়োজন এই ঘটনাগুলোর এত
সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং সহযোগীদের নৃশংসতার মাত্রা
বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়,সেজন্য বিস্তারিত পাঠ এবং আলোচনা প্রয়োজন।এগুলো
শুধুমাত্র সংঘটিত অপরাধের প্রকৃতি বোঝানোর জন্য কয়েকটি উদাহরণ হিসেবে
ব্যবহার করা হবে মাত্র।কেউ যেন ধরে না নেয় নির্যাতন,নৃশংসতা,হত্যার ভয়াবহতা
এরকম কয়েকটি ঘটনার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল,বরং এগুলোর চেয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে
১৯৭১ সালে।সেগুলো সম্পর্কে প্রচুর পরিমানে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।
এছাড়া ধর্ষণ এবং অন্যান্য নারী নির্যাতন সংক্রান্ত ঘটনাগুলো আলাদাভাবে আলোচনা করা হবে অন্য পর্বে।
আরেকটি ব্যাপারে খেয়াল রাখার অনুরোধ করছি,প্রত্যেকটি হত্যাকান্ড সংঘটনের
সাথে সাথে একাধিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।অনেক সময় একই ঘটনা একই সাথে
গণহত্যা,যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের উপাদান হিসেবে বিবেচিত
হওয়ার যোগ্য।এজন্য প্রতিটি অপরাধের সাথে উদাহরণ হিসেবে আলোচনা না করে
প্রতিটি ঘটনার বিবরণ শেষে সংঘটিত অপরাধগুলো চিহ্নিত করে দেয়া হবে।
খুলনার চুকনগর গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধকালে একদিনে সংঘটিত বৃহত্তম
গণহত্যা।এইদিন ভারতগামী শরণার্থীদের একটি জমায়েতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে
হত্যা করা হয় আনুমানিক দশ হাজার মানুষকে।গত শতকের গণহত্যার ইতিহাসে একদিনে
একই স্থানে এত বেশি সংখ্যক মানুষকে একসাথে হত্যা করার উদাহরণ সম্ভবত আর
নেই।দুঃখজনক হলেও সত্য,চুকনগর গণহত্যা একদিনে সংঘটিত বৃহত্তম গণহত্যা
হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি এখনো।এই নৃশংস হত্যাকান্ড নিয়ে যে
পরিমান গবেষণা এবং অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন ছিল তা হয়নি।
চুকনগর গণহত্যার বিবরণ শোনা যাক প্রত্যক্ষ্যদর্শী এরশাদ আলী মোড়লের কাছ
থেকে।এরশাদ আলীর পিতা চেকন আলো মোড়ল চুকনগর গণহত্যার প্রথম শহীদ।
চুকনগর বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূড়ে একটি রাস্তা আছে যেখান
থেকে মালথিয়া গ্রামে যাওয়া যায়।ঐ গ্রামে আমার বাড়ি।১৯৭১ দলের ২০ মে
বৃহস্পতিবার ৯-৩০ মিনিটের একটা মিলিটারির গাড়ি সাতক্ষীরার দিক থেকে চুকনগর
আসে।ঐ গাড়িতে খান সেনা আর কিছু বাঙালি ছিল।
আমি আমার বাবা ও বড় ভাই একসাথে ঐ রাস্তার পাশে জমিতে হালচাষ করছিলাম।তখন
মিলিটারির গাড়ি দেখে আমার নাম ধরে বললেন।' এরশাদ মিলিটারির গাড়ি
আসছে,তাড়াতাড়ি পালিয়ে যা ' এই কথা বলার সাথে সাথে আমরা দৌড়ে দু'শ হাত দূরে
আমাদের বাড়িতে চলে যাই।আমরা দূর থেকে দেখতে পেলাম খান সেনারা গাড়ী থেকে
নেমে আমার বাবাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে।কিন্তু কি জিজ্ঞাসা করছিল তা আমরা
জানতে পারিনি।আমরা দেখলাম আমার বাবা মিলিটারিদের মাথার উপর কাঁচি দিয়ে
মারতে যাচ্ছেন।এ সময় তারা বাবাকে গুলি করে।গুলি করার আগে বাবা চিৎকার করে
বলে ওঠেন, ' তোরা পালা। ' তখন আমরা নিজেদের বাড়ি থেকে আরও দূরে সরে যাই।
এর পর মিলিটারিরা রাস্তার অপর সাইডে চলে গেল এবং বটিয়াঘাটা,দাকোপ,ছিয়ানব্বই
গ্রাম ইত্যাদি এলাকা থেকে আগত হাজার হাজার শরণার্থীর উপর নির্বিচারে গুলি
করতে লাগলো।মিলিটারিরা প্রথমে মালথিয়া গ্রামে এসে আমার বাবাকে গুলি করে
হত্যা করে তাদের হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে।আমরা দেখতে পেলাম মেশিন গানের
ব্রাশফায়ারে হাজার হাজার মানুষ পাখির মতো পড়ে যেতে লাগলেন।বৃদ্ধ মহিলা
পুরুষসহ আনুমানিক ২ থেকে ৩ হাজার মানুষ সেখানে তারা হত্যা করে।
... এরপর মিলিটারিরা ওখানকার একটি রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিকে যায় এবং সেখান
থেকে চুকনগর বাজারে যেয়ে গুলি করে।বাজারে তাদের গুলিতে হাজার হাজার মানুষ
নিহত হন।চুকনগর সরদার বাড়ি ও অন্যান্য এলাকার প্রায় চার হাজার মানুষকে গুলি
করে হত্যা করে পাকি আর্মিরা।সকাল সাড়ে ন'টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত তারা
অবিরাম গুলি চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে।সাতক্ষীরা থেকে প্রথমে
এক গাড়ি পাকি আর্মি আসে,পরে আরো দু'গাড়ি আর্মি এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।এরপর
হত্যাযজ্ঞ শেষ হলে তারা গাড়িসহ সাড়ে তিনটায় সাতক্ষীরার দিকে চলে যায়।
... ২০-২৫ টা করে লাশ প্রতিদিন ঘ্যাংরাইল নদীতে আমরা টেনে ফেলেছি।চার
পাঁচদিন যাবত আমরা এই কাজ করি।আর চুকনগরে যে লাশ পড়েছিল তা সব ভদ্রা নদীতে
ফেলা হয়।
চুকনগর গণহত্যা সংঘটনকালে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলো হলো -
## হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে গণহত্যা সাধন
## ব্যাপক নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
## লক্ষ্যবস্তুর বাইরে ব্যক্তি ও বস্তুর উপর সীমাহীন আঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস,মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
প্রায় একই ধরণের আরেকটি হত্যাকান্ড ঘটেছিল কিশোরগঞ্জের বরইতলায়।তবে
প্রকৃতিগতভাবে এটি আরো ভয়ঙ্কর।নৃশংসতার দিক দিয়ে বরইতলা গণহত্যার তুলনা
ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন।১৩ অক্টোবর,১৯৭১ বরইতলা গ্রামের রেল লাইনের পাশে
এই হত্যাকান্ড ঘটে।এই ঘটনার বিবরণ শোনা যাক প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর
রাজ্জাকের কাছ থেকে -
এসময় প্রায় দেড় হাজারের মত লোককে তারা সেখানে জড়ো করে।সেখান থেকে কয়েক জনকে
ধরে জিওল গাছের নিচে নিয়ে গিয়ে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে।যাদেরকে আঘাত করা
হয় তাদের আঘাতের স্থানগুলো ফুলে ওঠে।তখন পাকি আর্মিরা শরীরের ফুলে ওঠা
অংশগুলো চাকু দিয়ে ফেড়ে দিতে থাকে।আমি এগুলো দেখতে গেলে আমাকে থাপ্পর মারে ও
লাঠি দিয়ে আঘাত করে।ঠিক এসময় গ্রামের আলবদর আব্দুল হাশিম পাকি ও আর্মিদের
খবর দে যে, 'মুক্তিবাহিনী এক পাকি সেনাকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে।' এ
কথা শোনার পর সেখানে অবস্থানরত পাকি মেজর সবার হাত পা বেঁধে ফেলার নির্দেশ
দেয়।তখন অনেকে বয়ে দৌড়ে মসজিদে যেয়ে ঢোকেন।যাদের গ্রামে রাজাকার ছিল তাদের
অনেককে এসময় ছেড়ে দেয়া হয়।প্রায় ৫০০ জন মানুষকে এভাবে হত্যার জন্য দাঁড়
করানো হল।তখন আমরা সবাই "লা ইলাহা ইল্লালাহু,মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ " বলে
জোরে জোরে কলেমা পড়তে লাগলাম।তখন মেজর বলল, 'এভাবে কলেমা পড়তে থাকলে তো
মারা যাবে না।' তারপর তারা ৩০ কেজি ওজনের রেললাইন ঠিক করা শাবল দিয়ে জনতার
প্রথম সারি থেম এমাথায় আঘাত করা শুরু করে।এতে অধিকাংশ লোকের মাথা চৌচির হয়ে
হয়ে তাদের রক্তমিশ্রিত ঘিলু ছিটকে পড়ে।অনেকে কাধ ও ঘাড় ভেঙ্গে যাওয়ায়
অজ্ঞান হয়ে পড়েন।এ সময় লাইন যারা ভয়ে দৌরে পালাচ্ছিলেন তাদের কাউকে কাউকে
জোর করে ধরে এনে বেত দিয়ে পিটিয়ে পুনরায় দাঁড় করানো হচ্ছিল,কাউকে কাউকে
আবার গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল।যাদেরকে শাবল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করতে
পারেনি,তাদেরকএ শেষে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
... সেদিন যে ৫০০ জনের উপর নির্যাতন চালানো হয় তার মধ্যে ৩৬৬ জন মারা
যান।বাকিরা আহত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন।এর মধ্যে কেউ কেউ পরে মারা যান।
সংঘটিত অপরাধসমূহ -
## হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে গণহত্যা সাধন
## ব্যাপক নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
## লক্ষ্যবস্তুর বাইরে ব্যক্তি ও বস্তুর উপর সীমাহীন আঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস,মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## শত্রু দেহ খন্ড বিখন্ড ও বিকৃত করণের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
সৈয়দপুরের গোলাহাট গণহত্যাও প্রকৃতিগত ভাবে অনেকটা একইরকম।তবে এক্ষেত্রে আরো একটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে -
সুপরিকল্পিত ভাবে শারীরিক ধ্বংস ও জীবননাশের মাধ্যমে গণহত্যা পরিকল্পনা এবং সংঘটন যা পরিনামে মানবজীবনকে নিশ্চিহ্ন করে।
১৩ জুন পাকিস্তান আর্মি সৈয়দপুরের ১৫০ জন লোককে ক্যান্টনমেন্টের ধরে নিয়ে
যায়।এরপর তাদেরকে ভারতে পৌছে দেয়ার নাম করে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনে
হয়।কৌশলে বন্দীদের পরিবারের সদস্যদেরও স্টেশনে আনা হয়।এই ফাঁকে চালানো হয়
নির্বিচার লুটপাট।ট্রেনের চারটি বগির পেছনের দুটোতে উঠানো হয় নারী ও
শিশুদের;বাকি দুটোতে পুরুষদের।দু'কিলোমিটার যাবার পর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের
একটি কালভার্টে এসে ট্রেনটি থেমে যায়।তারপরই শুরু হয় বীভৎস হত্যাযজ্ঞ।একজন
একজন করে নামানো হয়,আর খোলা তলোয়ারের কোপে দু'খন্ড কর ফেলা হয় তাদের
দেহ।জানালা ভেঙ্গে যারা পালাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে ব্রাশফায়ার করে
হত্যা করা হয়।গোলাহাটে পাকিস্তানিদের এই হত্যাকান্ড থেকে সেইদিন তেইশজন
পুরুষ পালাতে সক্ষম হলেও নারী ও শিশুদের মধ্যে কেউ পালাতে পারেনি।উপর্যুপরি
ধর্ষণ শেষে নারীদেরও হত্যা করা হয়।ঐদিন গোলাহাটে পাকিস্তানি সেনারা ৪১৩
জনকে হত্যা করে।
এই হত্যাকান্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে স্থানীয় বিহারিদের একাংশ।বাঙালি
ছাড়াও এদিন সৈয়দপুরে বসবাসকারী অনেক মাড়োয়ারি নিহত হয়।গোলাহাট গণহত্যা নিয়ে
১৯ অগাস্ট নিউইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় -
শত্রু দেহ খন্ড-বিখন্ড করে,পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার আরো একটি ঘটনা ঘটে ৩০
এপ্রিল,১৯৭১,পাকশী রেলস্টেশনে।এদিন আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আঠারো জনকে
ধরে নিয়ে এসে জড়ো করা হয় পাকশী স্টেশনের ওয়েটিং রুমে।বিভিন্ন ভাবে
নির্যাতন করার পর রাতে তাদের নিয়ে আসা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপরে।তাদের হাত
পা বেঁধে রেললাইনের উপরে শুইয়ে দেয়া হয়।এবং সবশেষে তাদের শরীরের উপর দিয়ে
চালিয়ে দেয়া হয় ট্রেনের ইঞ্জিন।ছিন্নভিন্ন লাশগুলো নিচে পদ্মা নদীতে ফেলে
দেয়া হয়।
এরকম আরো একটি ঘটনা জানা যায় খুলনার মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল কাইয়ুমের কাছ
থেকে।ঘটনাটি কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটির।প্রচন্ড এক যুদ্ধ শেষে
মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটিটি দখল করার পর সেখানকার একটি কক্ষে সৈয়দ গাজী নামক
একজন মুক্তিযোদ্ধার দেহ পাওয়া যায়,তিনি রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়ে বাইরে
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য পাচার করতেন।রাজাকারেরা তার প্রকৃত পরিচয় জেনে
যাবার পর তার সমস্ত শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সেই কাটা জায়গায় লবন লাগিয়ে
দেয়।এর পরে হাতে পায়ে পেরেক ঠুকে দেয়ালে আটকে রাখে।সৈয়দ গাজী হয়ে যান
বাস্তব একাত্তরের যীশু।
কপিলমুনির এই ঘটনায় যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে -
## শত্রু দেহ খন্ড বিখন্ড ও বিকৃত করণের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
## খুনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ
সুপরিকল্পিতভাবে শারীরিক ধ্বংস ও মানসিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে গণহত্যা
সাধনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ অপারেশন সার্চলাইট।একটু আলোচনা করলেই বোঝা
যাবে।বাঙালি জাতিকে শেঁকড় শহ নির্মূল করার এই পরিকল্পনাটি শুরু হয়
একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতেই।২২ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া,জেনারেল
পীরজাদা,জেনারেল মিটঠা ও জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া - এরা সবাই মিলে
আওয়ামীলীগ সমর্থকদের গুঁড়িয়ে দিতে একটি ব্যাপক গণহত্যার পরিকল্পনা
করে।সেসময় এ সংক্রান্ত কিছু চালাচালিও হয়েছিল।তবে চূড়ান্ত আঘাতের
পরিকল্পনাটি করে জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও জেনারেল রাও ফরমান আলী
খান।তারা ঢাকা জিওসির অফিসে বসে এটা তৈরি করে।মূল অপারেশন পরিকল্পনা তৈরি
করে রাও ফরমান আলী।জিওসির অফিসে একটি নীল কাগজের ওপরে কাঠপেন্সিল দিয়ে রচিত
হয় ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যার পরিকল্পনা।৭১ এর ২০ মার্চ ১৬ প্যারা
সম্বলিত পাঁচ পৃষ্ঠার অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনাটি জেনারেল টিক্কা ও
জেনারেল হামিদের কাছে পেশ করা হয় অনুমোদনের জন্য।সামান্য কিছু রদবদল করে
পরিকল্পনাটি অনুমোদিত হয়ে যায়।
এরপর জেনারেল খাদিম ও জেনারেল ফরমান আলী পূর্ব বাংলার বিভিন্ন ব্রিগেড
কমান্ডার যেমন - যশোরের ব্রিগেডিয়ার দুররানি,কুমিল্লার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল
সফি,চট্টগ্রামের লে. কর্নেল ফাতিমী এবং সিলেট,রংপুর,রাজশাহীর ব্রিগেড
কমান্ডারদের অবহিত করে।৫৭ ব্রিগেড কমান্দার ব্রিগেডিয়ার আরবাব ঢাকা শহর ও
শহরতলী অপারেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করে।আর কেজর খাদিম হোসেন রাজা পুরো
বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞের দায়িত্ব পায়।ঐ সময় মেজর জেনারেল ইফিতেখার জানজুয়া
এবং জেনারেল মিটঠা গণহত্যা এবং সশস্ত্র বাঙালি দমনে সহায়তা দিতে বাংলাদেশেই
ছিল।ঢাকা শহরের বস্তি ও বাড়িঘরগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দেবার দায়িত্ব পেয়েছিল
ক্যাপ্টেন সাইদ।
হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের উদাহরণ - বুদ্ধিজীবী
হত্যা।বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে পঙ্গু করে দিতে সারাদেশের
প্রসাসনিক কর্মকর্তা,সিভিল সার্জন,অধ্যাপক,শিক্ষক,সাহিত্যিক
সাংবাদিক,ডাক্তার,প্রকৈশলী সহ শিক্ষিত শ্রেণির মানুষদের বেছে বেছে,তালিকা
তৈরি করে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই।
২৬ মার্চ সকালে ঢাকা বশ্বাবিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একজন হাউজ টিউটর অধ্যাপক
অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে আরও দু'জনের সাথে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা
করা হয়।ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের রিডার এএনএম
মুনিরুজ্জামানকে তার পরিবারের তিন সদস্যসহ শহীদ মিনার সংলগ্ন ৩৪ নম্বর
বাড়িতে হত্যা করা হয়।অধ্যাপক জি সি দেব,জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকেও গুলি করা
হয় সেদিন।জি সি দেব তাতক্ষণিকভাবে মারা যান,২৭ মার্চ জ্যোতির্ময়
গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালে নেয়া হয়,তারপর মারা যান তিনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাটি তৈরি করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিসংখ্যান
বিভাগের কাজী সালেহ,গণিত বিভাগের প্রভাষক মুজিবর রহমান,ফলিত পদার্থ
বিজ্ঞানের ড. রফিক এবং বাংলা বিভাগের ড. আবু হেন আমোস্তফা কামালকে ধরে নিয়ে
গিয়ে নির্যাতন চালায়।ততকালীন উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন এ ব্যাপারে
তালিকা তৈরি করতে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে।সংস্কৃত ভাষার সহকারী অধ্যাপক
সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে হত্যা করে একটি গর্তে ফেলে রাখা হয়।হত্যা করা হয়
মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মীর আব্দুল কাইয়ুমকে,গণিত বিভাগের অধ্যাপক
হবিবুর রহমানকে।
মে মাসেই বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা নেয়া হয়েসময় ইয়াহিয়া সরকারের পক্ষ
থেকে একটি বিশেষ ফর্ম পাঠানো হয় কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর কাছে,মনে করা হয়
এদের সম্পর্কে তল্লাশির উদ্দেশ্যেই এই ফর্ম পাঠানো হয়।লন্ডন টাইমস পত্রিকা
এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দিলে,পরিকল্পনা তখনকার মত স্থগিত রাখা হয়।
একাত্তরের শেষার্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী শক্তি,মূল পরিকল্পনা করে রাও ফরমান
আলী।ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকা শহর জামাতে ইসলামীর
দফতর সম্পাদক এবিএম খালেক মজুমদারকে।অক্টোবর থেকে আলবদর বাহিনী এই
হত্যাযজ্ঞের প্রস্তুতি নেয়,নভেম্বর থেকে অনেক বুদ্ধিজীবীদের কাছে তারা
হুশিয়ারি পত্র পাঠাতে থাকে।
ঢাকার মিরপুর,মোহাম্মদপুর থানা এলাকার ব্রিগেডিয়ার রাজা,রমনা থানা এলাকার
ব্রিগেডিয়ার আসলাম,তেজগাঁও এলাকার ব্রিগেডিয়ার শরীফ এবং ধানমন্ডি এলাকার
ব্রিগেডিয়ার শফি ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যায় বিশেষ ভূমিকা রাখে।বুদ্ধিজীবী
হত্যার অপারেশন ইন চার্জ ছিল চৈধুরি মঈনউদ্দিন,প্রধান ঘাতক ছিল
আশরাফুজ্জামান।আশরাফুজ্জামান মিরপুর গোরস্থানে সাতজন বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষককে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে।জানা যায়,ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যার
জন্য পাঁচশ আলবদর সদস্যকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।আশরাফুজ্জামানের একটি
ডায়েরির দুটি পৃষ্ঠায় ১৯ জন বিশিষ্ট শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
চিকিৎসক গোলাম মর্তুজার নাম ও ঠিকানার উল্লেখ ছিল।এই বিশজনের মধ্যে ১৪
ডিসেম্বর আটজন নিখোঁজ হন।তারা হলেন- অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী,অধ্যাপক মোফাজ্জল
হায়দার চৌধুরি,অধ্যাপক আনোয়ার পাশা,ড. আবুল খায়ের,অধ্যাপক রশীদুল
হাসান,অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহমেদ,ড. ফয়জুল মহী ও ডা. মুর্তজা।
১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় বুদ্ধীজীবী হত্যার দ্বিতীয় অধ্যায়।এর প্রথম শিকার
ছিলেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন।এর পরপরই নিখোঁজ হতে থাকেন অনেকে।তাদের
অনেকেরই লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে,১৮ ডিসেম্বর।কারো লাশ পাওয়া
যায় মিরপুর বধ্যভূমিতে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরো কিছু জায়গায়।৫ জানুয়ারি
মিরপুর গোরস্থানে পাওয়া যায় সন্তোষ ভট্টাচার্য,ড. সিরাজুল হক,ড. ফয়জুল মহী ও
ডা. মুর্তজার লাশ।দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন
হোসেন,সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার,সাবের পিআইএ এর ব্যুরো চীফ ও
বিবিসি সংবাদদাতা নিজামুদ্দিন আহমেদ ও চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হকের
লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনাগুলো উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের উপাদান হিসেবেও গণ্য হবে।
নিচের বিবরণটি লক্ষ্যবস্তুর বাইরে ব্যক্তি ও বস্তুর উপর সীমাহীন আঘাতের
মাধ্যমে ধ্বংস,মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের
একটি নমুনা।এটি জানা যায় ঢাকার উত্তরার সালেহা বেগমের কাছ থেকে।
৮ ডিসেম্বর রাতে ভয়ঙ্কর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল।তখন শুনতে পেলাম তেজগাঁওতে
বোম্বিং করা হচ্ছে।তেজগাঁওতে আমাদের সব মালামাল ও গরু বাছুর থাকায় সকালে
পায়ে হেঁটে পুনরায় তেজগাঁও আসলাম।রাস্তায় দেখলাম মানুষজন ঢাকা ছেড়ে চলে
যাচ্ছে।কোন যানবাহন তখন রাস্তায় ছিল না।সেখানে গিয়ে শুনলাম তেজগাঁও
এতিমখানায় বোম্বিং করা হয়েছে,কি ঘটেছে তা দেখার জন্য পায়ে হেঁটে এতিমখানার
সামনে গেলাম।সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে
গেল,ধ্বংসস্তুপের মাঝে কতগুলো এতিম শিশুর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ পরে আছে।
৪.
উপরের ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী
শক্তির দ্বারা হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের কয়েকটি নমুনা
মাত্র।এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে সেসময়,সারা বাংলাদেশেই।গণহত্যার ভয়াবহতা
এবং হত্যাকান্ডের নির্মমতা বুঝতে,মানবিকতার বিপর্যয়ের মাত্রা বুঝতে এরকম
আরো কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হল।
সালেমা বেগমের কাছ থেকেই জানা যাক একটি শিশুহত্যা এবং একজন অপ্রকৃতিস্থ বৃদ্ধের বিবরণ -
একটা ছোট বাচ্চা ছেলে ওই বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের
পতাকা নাড়ছিল ও মুখে জয়বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছিল।এই 'জয়বাংলা' শব্দটা
পাকিস্তানি আর্মির কানে যাবার সাথে সাথে তারা ওই বাসার দোতলাইয় উঠে
যায়।বাচ্চাটার হাতে তখনও পতাকাটা ধরা ছিল।হানাদাররা প্রথমে পতাকাটা ছিনিয়ে
নিয়ে ছেলেটার মাথার মধ্যে পতাকার লাঠিটা ঢুকিয়ে দেয়।বাচ্চাটি তখন যন্ত্রণায়
মাটিতে পরে যায়।এসময় ছেলেটার মা,বাবা ও দাদা,দাদী সেখানে ছুটে
আসেন।আর্মিরা বাচ্চাটির বাবা ও দাদাকে বেঁধে রেখে তাদের সামনেই মা ও দাদীকে
উপর্যুপরি ধর্ষণ করে।ধর্ষণ শেষে বাবা ও দাদাকে গুলি করে হত্যা করে।
... এই বৃদ্ধ,তার ছেলে ও নাতি তিনজনকে আর্মিরা বলে, 'তোমাদের মারবো
না,তোমরা এই পুকুর পাড়ে চলে এসো' ।তারা তিনজন পুকুর পাড়ে চলে আসলে তাদেরকে
সেই বিশাল পুকুর এপার থেকে সাঁতরে ওপার হয়ে ফিরে আসতে পারলে হত্যা করা হবে
না বলে আর্মিরা জানায়।তখন তারা তিনজন প্রথমবার সাঁতরে ফিরে আসলে তাদেরকে
দ্বিতীয়বার সাঁতরিয়ে আসতে বলে।দ্বিতীয়বার সাঁতরে আসলে তাদেরকে তৃতীয়বার
সাঁতরে ফিরে আসার জন্য বলা হয়।তৃতীয়বার সাঁতরে আসলে তাদেরকে চতুর্থবার
সাঁতরে ফিরে আসার জন্য বলা হয়।তারা তখন খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন।কিন্তু জীবনা
বাঁচানোর তাগিদে তারা মরিয়া হয়ে সাঁতরাচ্ছিলেন।আসলে পাকিস্তানী আর্মিরা
তাদের জীবন নিয়ে স্রেফ কৌতুক করছিল।চতুর্থবার যখন সাঁতরিয়ে কোনরকমে
মাঝপুকুরে যান তখন তাদের উপর আর্মিরা ব্রাশফায়ার করে।এই ব্রাশফায়ারে ওই
বৃদ্ধের ছেলে ও নাতি নিহত হন।কিন্তু বৃদ্ধ ব্যক্তিটি আহত অবস্থায় বেঁচে
যান।পরে নাতি ও ছেলের শোকে তিনি পাগল হয়ে যান।
বিয়ানীবাজারের ময়না মিয়াকে বাধ্য করা হয় তার পরিচত জন রুপীচরণ দাসকে জবাই
করতে।হিন্দু বলে তাকে হত্যা করতে কোন গুলি খরচ না করার সিদ্ধান্ত নেয়
পাকিস্তানি সৈনিকেরা।ময়না মিয়াকে ডেকে নির্দেশ দেওয়া হয় ধান কাটার কাস্তে
দিয়ে রুপীচরণকে জবাই করতে।ময়না মিয়া গলা কাটার ভান করেন কাস্তের উলটো দিক
দিয়ে।তাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকার ভান করতে বলেন।কিন্তু ময়না মিয়া কিছুদূর
চলে যাবার পর রুপীচরণ দাস মাথা তুলে দেখতে যান সৈন্যরা চলে গেছে কি না।এটা
দেখে ফেলে তারা।তখন আবার ময়না মিয়াকে ডেকে এনে বুকে বন্দুক ধরে বাধ্য করা
হয় জবাই করতে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বিয়ানী বাজারের ঢেউনগর গ্রামে হামলা চালায়
পাকিস্তান সেনাবাহিনী।এসময় তারা বারিন্দ্র নমশূদ্রকে পেয়ে যায় গ্রামের
কালাচাঁদ মন্দিরের কাছে।দেখা মাত্রই গুলি করা হয় তাকে।গুলি তার বুক ফুড়ে
বেরিয়ে যায়।তারপরও তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য কাছে গিয়ে ঠান্ডা মাথায়
গুলি করা হয়।কুশিয়ারা নদীতীরে ফেলে রাখা হয় তার লাশ।শেয়াল-কুকুর-শকুনের
টানাটানির পরে একসময় তার লাশ বানের পানিতে ভেসে যায়।
নিউজউইক পত্রিকায় ২ অগাস্ট ১৯৭১, BENGAL : THE MURDER OF A PEOPLE শিরোনামে
একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।এখান থেকে একটি ঘটনা জানা যায়,শরীর
থেকে ক্রমাগত রক্ত বের করে নিয়ে হত্যা করার একটি ঘটনা -
Assembling the young men of the village of Haluaghat in East Pakistan,a
Pakistani Army major informed them that his wounded soldiers urgently
needed blood.Would they be donor?The young men lay down on makeshift
cots,needles were inserted in their veins,and then slowly the blood was
drained from their bodies until they died.
৫.
এখানে উল্লিখিত ঘটনার মত আরো হাজার হাজার ঘটনা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের সেই
ভয়াবহ দশটি মাসে।১৯৭১ সালে সমস্ত বাংলাদেশই ছিল একটি মাইলাই,সমস্ত
বাংলাদেশই ছিল একটি অখন্ড বধ্যভূমি।পরিকল্পিত এই গণহত্যা সুনির্দিষ্টভাবে
পরিচালিত হয় বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে,বাঙালি জাতির মেরুদন্ড
ভেঙ্গে দিতে।গণহত্যার এইসব বিবরণের বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন।পাঠ্যবইয়ে
লেখা 'তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' জাতীয় দুই একটি বাক্য দিয়ে দায় সারার
চেষ্টা নিতান্তই হাস্যকর শোনায়।
এই পর্বে হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা হল।আগামী পর্বে নারী নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধসমূহ আলোচনা করা হবে।
তথ্যসুত্র
১) যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ - ডা. এম এ হাসান
২) '৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ - ডা. এম এ হাসান
৩) একাত্তরের গণহত্যা : রাজধানী থেকে বিয়ানীবাজার - আজিজুল পারভেজ
৪) একাত্তর : নির্যাতনের কড়চা - আতোয়ার রহমান
৫) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে শত্রুমিত্র - সিরু বাঙালি
৬) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ( অষ্টম খন্ড ) - হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত
কৃতজ্ঞতা
অমি রহমান পিয়াল
এম এম আর জালাল
( প্রথম প্রকাশ :
১০/০৪/২০১২,আমারব্লগডটকম )